কুড়িগ্রামের রাশেদুজ্জামান চাকরি করতেন ঢাকার একটি পাঁচতারা হোটেলে। তাঁর ভাই কাজ করেন একটি সিরামিক পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানে। দুই ভাই উত্তরায় ভাড়া থাকতেন। রাশেদুজ্জামানের চাকরি নেই। উত্তরার বাসা ছেড়ে কুড়িগ্রামের কলেজ রোডে তাঁদের বাড়িতে উঠেছেন। অন্য ভাই সাদেকুজ্জামানের বেতন কমে অর্ধেক হয়েছে। তিনি শ্যামলীতে একটি মেসে উঠেছেন।
রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘আমার চাকরি নেই। ছোট ভাইয়ের বেতন কমেছে। সেই কারণে বাসা ছাড়তে হয়েছে। আমি এখন কুড়িগ্রামের বাড়িতে আছি বাবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে। বাবা পেশায় একজন শ্রমিক।’
করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাঁটাই ও বেতন কমানো, বাসাবাড়ি ও মেসে নারী গৃহকর্মীদের কাজ না থাকা, সড়কে ভাসমান দোকানে বিক্রি সংকুচিত হয়ে আসা এবং ভিক্ষার পরিমাণ কমে আসায় ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। মধ্যবিত্ত অনেকেই বাসাভাড়ার চাপে তাদের পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছে গ্রামে। পরিবারপ্রধান থাকছেন মেস ভাড়া নিয়ে। জুন মাসের প্রথম থেকেই ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাড়িভাড়ার সাইনবোর্ডের সংখ্যা বেড়েছে।
ভাড়াটিয়া পরিষদ নামের একটি বেসরকারি সংগঠনের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেছেন, ‘আমাদের কাছে যে হিসাব রয়েছে, তাতে এরই মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার লোক বাসা ছেড়ে দিয়েছে।’
রাজধানীতে ভাসমান মানুষ ও বস্তিবাসীদের নিয়ে কাজ করা ‘সাজেদা ফাউন্ডেশন’-এর কর্মকর্তারা নিম্ন আয়ের মানুষের ঢাকা ছাড়ার বিষয়টি জানেন বলে নিশ্চিত করেছেন।
তবে কী পরিমাণ মানুষ করোনার প্রভাবে ঢাকা ছেড়েছে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই সরকারি কোনো দপ্তর বা সিটি করপোরেশনের কাছে।
২০১১ সালের সর্বশেষ আদমশুমারি অনুসারে, রাজধানীর জনসংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ভাড়াটিয়া পরিষদের হিসাব মতে, এর মধ্যে ৮০ শতাংশ লোক ভাড়ায় বসবাস করে। সে হিসাবে ঢাকা শহরে ভাড়ায় থাকে এক কোটি ৩৬ লাখ মানুষ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার কারণে মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে সমাজের শ্রেণি কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটে গেছে।
গত ৮ জুন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি একটি জরিপ তথ্য প্রকাশ করেছে। ওই জরিপে বলা হয়েছে, সাধারণ ছুটির ৬৬ দিনে দেশের তিন কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন লোক চাকরি বা উপার্জন হারিয়েছেন। করোনার বিস্তার ঠেকাতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির আগে দেশে মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৪০ লাখ। ছুটির ৬৬ দিনেই ‘নবদরিদ্র’ মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় কোটি ৮০ লাখে।
অর্থনীতি সমিতির মতে, সাধারণ ছুটির কারণে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা। বিশেষ করে ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা, চা-পান-সিগারেট, খুদে দোকান, মুদি দোকান, ক্ষুদ্র হোটেল, রেঁস্তোরা, মাঝারি পাইকারি ব্যবসা। সারা দেশে এ ধরনের ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৮৬ লাখের ওপরে। তাদের ওপর নির্ভরশীল সাত কোটি ৮০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ।
প্রায় ১০ বছর পর পরিবারের লোকজনকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দায় পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা তৌহিদ আহমেদ। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বাড়িভাড়ার চাপে অসহ্য হয়ে পড়েছি। বেতন অনিয়মিত, তাই গ্রামে ঘর মেরামত করে পরিবার বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
গৃহকর্মী ফাতেমা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের গ্রামে।তিনি বলেন, ‘আমি তিনটি বাসায় বুয়ার কাজ করতাম। এখন কাজ নেই। স্বামী ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করত, তাও বন্ধ। ঢাকায় চলার মতো অবস্থা নেই। এখন গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। দেখি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গ্রামে কিছু করতে পারি কি না?’
রায়েরবাজারের বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন শামীম ও নূর জাহান দম্পতি। তাঁদের তিন সন্তান। স্বামী ছিলেন একটি বাড়ির প্রহরী। এখন চাকরি নেই। নূরজাহানেরও বুয়ার কাজ নেই। তাঁরা জামালপুরের সরিষাবাড়ীর গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। শামীম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৫ দিন আগে গিয়ে গ্রামের ঘর মেরামত করে এসেছি। গ্রামেই ফিরে যাব।’
সেকেন্দার আলী ২০ বছর ধরে মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে চায়ের দোকান করেন। তিনি বলেন, এখন বাইরের দোকানে কেউ চা পান করতে আসে না। আয়-রোজগার বন্ধ। একদিকে দোকান ভাড়া, অন্যদিকে বাড়িভাড়া। আছে সংসার খরচ। কোনোভাবে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তাই সব ছেড়ে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার গ্রামে ফিরে যাচ্ছি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন মোল্লা বলেন, ‘বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা লোকজনই বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া দেখছি, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকেরাও পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে নিজেরা মেস করে থাকতে শুরু করেছেন।’
সাজেদা ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক এম ফারুক বলেন, ‘আমরা জরিপ করছি। দেখছি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, বস্তিতে বসবাসকারী ও ভাসমান লোকেরাও ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। বস্তিতে থাকতে হলেও তিন-চার হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। সেটাও জোগাতে পারছে না তারা। অন্যদিকে সড়কে লোক কম থাকায় ভিক্ষার পরিমাণও কমেছে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি বাড়িভাড়ার চাপে মূলত মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। সিটি করপোরেশন বাড়িভাড়ার বিষয়টি দেখে না। তবে আমি মনে করি, বাড়িভাড়ার বিষয়টি সিটি করপোরেশনের হাতে থাকা উচিত’
রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও বেশ কয়েকজন বাড়িওয়ালার সঙ্গে সাধারণ ছুটি থাকায় অনেকেই দু-তিন মাসের বাসাভাড়া দিতে পারেননি। এখন অনেকেই হয়তো কাজে ফিরেছেন; কিন্তু আগের তুলনায় আয় কমে গেছে। অনেকেই বাসা ছেড়ে দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে বাড়ির মালিকদের ওপর। যারা ভাড়ার ওপর নির্ভরশীল তারা বিপাকে পড়েছে।
মিরপুর-১২ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের ২০ নম্বর সড়কের বাড়িওয়ালা জামান মিয়া বলেন, ‘আমার এক ইউনিটের তিনতলা বাড়ির একটি ইউনিটে আমি পরিবার নিয়ে বসবাস করি। অন্য দুটি ইউনিটে ভাড়াটিয়া ছিল। একটি পরিবার চলে গেছে। অন্য পরিবার নোটিশ দিয়েছে, তারা গ্রামে চলে যাবে বলে জানিয়েছে।’
শরীফ আহমেদ ঢাকায় চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ মালিক বিদায় করে দিলেন। এখন গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। বাড়ির মালিককে জানিয়ে দিয়েছি।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মাদ শরিফুর রহমান বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে করোনা সংক্রমণের মাসখানেক পর থেকেই দেখছি অসংখ্য বাড়িতে ‘টু-লেট’ ঝুলছে। বহু মানুষ বাসা ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘অনেক মানুষ ঢাকা ছাড়ছে এটা ঠিক। তবে এর সংখ্যা আমাদের কাছে নেই। বাসাবাড়ি খালি হলে আমাদের রাজস্বও কমে যাবে। তবে কী পরিমাণ রাজস্ব কমবে, তা জানতে আরেকটু সময় লাগবে।’ (কালের কণ্ঠ)
বার্তা কক্ষ,২৫ জুন ২০২০