ঘড়ির কাটায় তখন সাড়ে ১১টা। চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ২১০নং কক্ষের সামনে রোগীদের দীর্ঘ লাইন। বিভিন্ন বয়সের প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন নারী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন গাইনী চিকিৎসক শামসুন্নাহার তানিয়ার অপেক্ষায়। বাইরে বসার মতো কোনো চেয়ার বা আসন না থাকায় কোলের শিশুসন্তান নিয়ে কয়েকজন মা বসে পড়েছেন মেঝেতে।
একই চিত্র দেখা গেলে ডা. মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের কক্ষের সামনে। অসুস্থতার কারণে কেউ কেউ দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে না পেরে দেয়ালে হেলান দিয়ে তন্দ্রাকাতর হয়ে আছেন বেঞ্চের ওপর। আবার কেউ ঘুরছেন বারান্দায়, কেউ বা বাইরে। তাদেরও অপেক্ষা চিকিৎসকের জন্যে। এ অপেক্ষার শেষ কোথায় তাও জানা নেই কারও।
এই প্রতিকেদকে ছবি তুলতে দেখে কেউ কেউ লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলেন। পঞ্চাশর্ধো একজন নারী এগিয়ে এসে বললেন, ডাক্তার কখন আইবো বাবা? আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পীঠের ব্যথা বেড়ে গেছে। এমন প্রশ্নের উত্তর জানা নেই প্রতিবেদকের কাছে। এমনকি ডা. মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের কক্ষে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিও জানে না। অাধঘন্টা পর, অর্থাৎ বেলা ১২টায় এসেও দেখা যায় একই চিত্র। দুটি কক্ষের সামনে রুগীর সংখ্যা বাড়লেও ডাক্তার আসার সময় হচ্ছে না। তবে দুজন ডাক্তারের খালি চেয়ার-টেবিলের উপর সিলিং ফ্যান দুটি অনবরত ঘুরছে।
প্রতিনিয়ত এভাবেই অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয় চাঁদপুর আড়শ’ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় রোগীদের। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে হাসপাতালের অফিস রুমে বসার কথা দায়িত্বরত চিকিৎসকদের। কিন্তু তারা নিয়ম না ব্যক্তিগত চেম্বার আর প্রাইভেট ক্লিনিকেই রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কোনো প্রকার জবাবদিহিতা না থাকায় তাদের কাছে অনিয়ম এখন নিয়মে পরিনত হয়েছে বলে মনে করে ভুক্তভোগী রোগীরা।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা এক গর্ভবতী নারী জানান, সকাল সাড়ে ৮টায় তিনি বাড়ি থেকে বেড়িয়েছেন। হাসপাতালে এসে টিকেট কেটে ১০টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, গাইনী চিকিৎসক শামসুন্নাহার তানিয়াকে দেখাবেন বলে। কিন্তু ১০টার সকাল গড়িয়ে ১২টার বেলা হলেও ডাক্তার আসার নাম নেই। ২১০নং কক্ষের দায়িত্বে থাকা লোকটা বার বার বলছেন, ডাক্তার আছেন, এক্ষনই চলে আসবেন।
নাম বলতে অনিশ্চুক আরেক নারী রোগী বলেন, সাংসবাদিকদের কাছে অভিযোগ করলে আজকে আর ডাক্তারের সিরিয়ালই পাবো না। তবে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফারজানা নামে একজন এই প্রতিবেদককে বলেন, দয়া করে আপনারা কিছু করেন। সেই সকালে আসছি, এখন ১২ টা বাজে অথচ এখনও ডাক্তার আসেনি। তাহলে কখন আসবে, কখন রোগী দেখবে।
হাজীগঞ্জ উপজেলার থেকে আগত ৫০ উর্ধো নারী নার্গিস বেগম বলেন, আমরা গরীব মানুষ। প্রাইভেটে ডাক্তার দেখানের মতো টাকা নেই। তাই পীঠ ব্যথার জন্যে ডাক্তার দেখাতে চাঁদপুর এসেছি। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ডা. মোহাম্মদ আনিসুর রহমান স্যারের রুমের সামনে সিরিয়াল ধরেছি। দাঁড়ায়া থাকতে থাকতে পীঠের ব্যথা বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর আড়াই’শ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হাবিব-উল-করিম করিম বলেন, হাসপাতালে ৬৪ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও আছেন, ৪৮ জন। তার মধ্য দুজন ছুটিতে আছেন। তবে চিকিৎসক সঙ্কট থাকলেও রোগীসেবা ব্যহত হচ্ছে না। সবাই মোটামুটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। চিকিৎসকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আমরা তদারকি করছি।
উল্লেখিত চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির এই সর্বোচ্চ কর্মকর্তা বলেন, সবকিছুর পাহারা দেয়া সম্ভব না। কিছু বিষয় বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়। চিকিৎসক মানেই সেরা ছাত্র। সেরা ছাত্ররাই চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ে হন। সেই তারাই যদি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করেন, সেটি কষ্টদায়ক। তবে বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে দেখবো।
জেলার গরীব ও মধ্যবিত্তদের সরকারি চিকিৎসা সেবার সর্বোচ্চ এই প্রতিষ্ঠানটিততে বেশিরভাগ চিকিৎসকই সময়মতো অফিস করেন না। কেউ কেউ ঠিক সময়ে এলেও প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের কল পেলেই ছুটে চলেন। সরকারি বেতন-ভাতা পাওয়া কোনো কোনো চিকিৎসক আবার নিজেরাই প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতালের পার্টনার। ফলে তাঁদের কাছে সরকারি দায়িত্ব পালনের চেয়ে বেশি দরকারি প্রাইভেট চেম্বার ও প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখা।
এর থেকে উত্তরণে এবং সাধারণ রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিষয়টি নজরে এনে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কার্যত ব্যাবস্থা নেয়া দাবী জানান রোগীরা।
প্রতিবেদক : আশিক বিন রহিম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০