ছাত্র রাজনীতির প্রতি দেশের মানুষের অনাস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন না হলে বাংলাদেশে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হবে। গতকাল দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম জমকালো সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতির সূতিকাগার উল্লেখ করে বলেন, ছাত্র রাজনীতির সুফল বয়ে আনতে সত্যিকারের নিয়মিত ছাত্রদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ দিতে হবে। আর তাই ডাকসু নির্বাচন অতি জরুরি। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বে শূন্যতায় পরিণত হবে দেশ। এ জন্য অতিদ্রুত ডাকসু নির্বাচন দেয়ার কথা বলেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই নেতৃত্ব তৈরি হবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই। আমি নিজেও ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি লাভ করি। কিন্তু আমাদের সময়ের রাজনীতি আর আজকের ছাত্র রাজনীতির মধ্যে অনেক তফাত। এটি একটি দেশ ও জাতির জন্য শুভ নয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তিনি বলেন, ষাটের দশকে আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম, লক্ষ্য ছিল দেশের কল্যাণ করা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের স্থান ছিল না। ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির বর্তমান হালচাল দেখলে মনে হয় এখানে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের প্রাধান্য বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ-ছাত্ররাই রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়াসহ নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর ফলে ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য ছাত্র সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের খেলার মাঠে এই সমাবর্তন হয়। রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো: আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে এবারের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওয়ের প্রেসিডেন্ট ও ভিসি অধ্যাপক অমিত চাকমা। ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সাইটেশন পাঠ ও ভাষণ প্রদান করেন। প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এ সময় প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো: কামাল উদ্দীনসহ মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রধান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সিন্ডিকেট সদস্য ও একাডেমিক পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা অধ্যাপক অমিত চাকমাকে ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ ডিগ্রি ছাড়াও ঢাবির ৬১ জন গবেষককে পিএইচডি, ৪৩ জনকে এমফিল, ৮০ জনকে স্বর্ণপদক এবং ১৭ হাজার ৮৭৫ জন গ্র্যাজুয়েটকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনরা অনুষদভুক্ত বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের ডিগ্রিপ্রাপ্ত গ্র্যাজুয়েটদের নাম উপস্থাপন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মো: এনামউজ্জামান সমাবর্তন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন।
ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, আমি ছাত্র রাজনীতি করেছি। কলেজের ভিপি-জিএস ছিলাম। নির্বাচিত। তখন ছাত্রদের সাথে আমরা এত ভালো ব্যবহার করেছি, চলেছি যেন তারা আমারে ভোট দেয়। কেউ অসুস্থ হলে তাদের দুর্বল করার জন্য ডাব-কলা-আনারস নিয়ে হাজির হয়ে যেতাম; যাতে আমাদের দলে সম্পৃক্ত হয়। যারা বাইরে থেকে আসত, তাদের ফরমও ফিলাপ করে দিতাম। এখন কী হইছে বুঝি না।
তিনি ছাত্র রাজনীতিতে নিয়মিত ছাত্রদের অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, ৫০ বছর বয়সে যদি নেতৃত্ব দেন, তাহলে যাদের বয়স ২০-২২-২৫ বছর, তাদের সাথে অ্যাডজাস্টমেন্ট কিভাবে হবে? সুতরাং ডাকসু নির্বাচন ইজ আ মাস্ট। নির্বাচন না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে শূন্যতার সৃষ্টি হবে।
নিজের স্মৃতিচারণ করে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ বলেন, আমাদের সময়ে ভালো রেজাল্টকারীদের কৌশলে দলের সাথে সম্পৃক্ত করতাম। নির্বাচনে আমাদের ভোট দিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভর্তি করতাম। তারা আমাদের ভালোবাসত। এখন কী হচ্ছে বুঝি না! ছাত্রনেতাদের বয়স যদি ৪৫-৫০ বছর হয় তাহলে তারা কিভাবে ২১ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে অ্যাডজাস্ট করবে?
ঢাবিকে রাজনীতির সূতিকাগার অভিহিত করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বরেণ্য রাজনীতিবিদের জন্ম দিয়েছে। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এখনো পথপ্রদর্শক হিসেবে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঢাবির অবদানের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ বলেন, যেকোনো অন্যায়, অবিচার ও অপশাসনের প্রতিবাদে এবং আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যেকোনো হুমকি মোকাবেলায় এ দেশের ছাত্রসমাজ বারবার এগিয়ে এসেছে। এ জন্য অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। জেল-জুলুম ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তারুণ্যের জোয়ার কখনো থেমে থাকেনি এবং ভবিষ্যতেও থেমে থাকবে না।
গ্র্যাজুয়েটদের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর পেছনে রয়েছে তোমাদের পিতামাতা, শিক্ষকমণ্ডলীসহ সমাজ, দেশ ও জনগণের বিপুল অবদান। তোমরা তাদের কাছে ঋণী। তোমরা সমাজ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তোমাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও কর্ম দিয়ে জাতির আশা আকাক্সক্ষা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সব সময় নৈতিক মূল্যবোধ, বিবেক ও দেশপ্রেম জাগ্রত রাখবে। কখনো অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথানত করবে না।
রাষ্ট্রপতি বলেন, তরুণেরাই জাতির কর্ণধার। ভবিষ্যতে তারাই দেশ পরিচালনা করবে। আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে অধিক যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবেলায় সব সময় সাহসী ও উদ্যোগী হতে হবে। তোমাদের সঠিক নেতৃত্বে দেশ হবে সমৃদ্ধ-উন্নত।
রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, জাতি তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে রাখতে হবে নিজেদের আত্মপরিচয়ের কথা, মাতৃতুল্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় দেশটির কথা। ভুললে চলবে না তোমাদের সামান্যতম নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও আমাদের বিশাল অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। কর্ম উপলক্ষে তোমরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো না কেন এ দেশ ও জনগণের কথা ভুলিও না। তোমরা বড় হও, সফল হও। গ্র্যাজুয়েটদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করেন রাষ্ট্রপতি।
সমাবর্তন বক্তা কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওয়ের প্রেসিডেন্ট ও ভিসি অধ্যাপক অমিত চাকমা বলেন, জীবনে সফল হওয়ার জন্য তিনটি বৈশিষ্ট্য জরুরি। তা হলোÑ যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও চারিত্রিক গুণ। নিজের দক্ষতা ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে এসব গুণ অর্জন করতে হবে। ভালো ও মন্দের বিচার করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নীতির ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নীতিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সব গ্র্যাজুয়েট নেতৃত্ব দিলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞানভিত্তিক কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। সব শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। শুধু সার্টিফিকেট অর্জন বা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে দেশের কল্যাণ সাধন সম্ভব নয়। এ জন্য তাদের ভালো মানুষ হতে হবে। বর্তমান বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে ছাত্রছাত্রীদের আন্তর্জাতিক মানের গ্র্যাজুয়েট হতে হবে।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের ইতিহাস এক ও অভিন্ন উল্লেখ করে বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র থাকাকালে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। পরে তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। নতুন প্রজন্মকে এই ইতিহাস জানতে হবে।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০১: ০০ এএম, ০৫ মার্চ ২০১৭, রোববার
ডিএইচ