বিশেষ সংবাদ

মসজিদের ইমাম কন্যা শামিমার ট্রাভেল গ্রান্ট সাফল্য

বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম। মেয়ে তার কাছ থেকে পেয়েছে মানুষ হওয়ার শিক্ষা। রক্ষণশীলতা, বোরকার মোড়কে যে-সমাজকে বারবার অপ্রগতিশীল বলে আক্রমণ করা হয়, সেই সমাজে থেকেই ইমাম সাহেবের মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সেই শিক্ষাই আনে প্রকৃত সাফল্য।

জীবনে ধরা দেয় অনেক সাফল্যও। আর্থিক দুরবস্থা সত্ত্বেও তাই হিজাব-নামায-রোযাকে সঙ্গী করেই সেই অর্জন সম্ভব হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের নিশ্চিন্তপুরের মেয়ে পাড়ি দিচ্ছেন লন্ডনে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে। তবে এর গুরুত্ব অন্য জায়গায়।

বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা-জার্নাল ‘নেচার’ জীববিদ্যা– রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাত্র তিনজনকে ট্রাভেল গ্রান্ট দিয়ে বিদেশের নামকরা প্রতিষ্ঠান-আয়োজিত সম্মেলনে গবেষণাপত্র পাঠের সুযোগ দেয়। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ টাকার এই ট্রাভেল গ্রান্ট পাচ্ছেন বর্ধমানের মেয়ে ড. শামিমা খাতুন। এ বছর সারা বিশ্বে শামিমা ছাড়া আর মাত্র দু’জন এই গ্রান্ট পাচ্ছেন। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের আয়োজনে আগামী ১৯ থেকে ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ওই কনফারেন্সে অংশ নেবেন শামিমা।

শামিমা জানান, গ্রামের মুসলিম মেয়েরা সুযোগের অভাবে অনেক সময় পিছিয়ে পড়ে। তবে আমার আব্বা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমাকে আল-আমীন মিশনে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম স্যারের সাহায্য আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। স্বামী ড. তাহাসিন মণ্ডলের কাছ থেকেও সবরকমের সাহায্য পেয়েছেন বলে জানান শামিমা।

বর্ধমানের নিশ্চিন্তপুর থেকে লন্ডনে স্বপ্নের উড়ানের আকাশপথ অবশ্য খুব একটা সুগম নয়। তাঁর আব্বা সেখ রহমত আলি (৫৭) ছিলেন মসজিদের ইমাম। নিকটবর্তী গ্রাম খেজুরহাটিতে রয়েছে একটি স্টেশনারি দোকানও। সেই গ্রামেরই মসজিদে ইমামতি করতেন তিনি। এখন বয়সের কারণে ইমামতি করতে পারেন না। নিম্নবিত্ত পরিবার হলেও মেয়ের পড়াশোনায় কোনও আপস করেননি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক রহমত আলি। পড়তে পাঠান বাংলায় মিশনারী শিক্ষা আন্দোলনের সূচনাকারী অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠান আল আমীন মিশনে। সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন শামিমা। তারপর কেমিস্ট্রি নিয়ে বিএসসি এবং এমএসসি পাস করেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আলিগড় থেকেই গত বছরে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সিএসআইআর-এর একটি প্রজেক্টে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি বিভাগে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত আছেন। লন্ডনের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে শামিমা তাঁর যে গবেষণাপত্রটি পড়বেন, সে সম্বন্ধে তিনি (টাইটেল— এক্সপ্লোরিং দ্য থার্মোডায়নামিকস্ অ্যান্ড কনফরমেশনাল অ্যাসপেক্টস অফ সুলিনডাক অ্যান্ড ক্লোরপ্রোম্যাজিন বাইন্ডিং উইথ বিএসএ) জানান, এটি প্রোটিনের সঙ্গে ড্রাগের আন্তঃক্রিয়া নিয়ে লিখিত একটি পেপার ।

১৮৬৯ সাল থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক সাপ্তাহিক জার্নাল ‘নেচার’ প্রকাশিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম সেরা জার্নাল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নেচার জার্নাল যে বার্ষিক মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশের আয়োজন করে, সেই উপলক্ষ্যে অংশগ্রহণকারীদের ট্রাভেল গ্রান্ট সম্মানী হিসাবে দিয়ে থাকে কর্তৃপক্ষ। বায়োলজি, কেমিস্ট্রি এবং ফিজিক্স এই তিনটি বিষয়ে ট্রাভেল গ্রান্ট দিয়ে থাকে নেচার। প্রতি বছর বিশ্বে মাত্র একজনকে কমিউনিকেশনস কেমিস্ট্রি গ্রান্ট দেওয়া হয়, যা এবার অর্জন করেছেন বাঙালি-কন্যা শামিমা। নেচার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গবেষণা ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় কৃতীদের অনুপ্রেরণা জোগাতেই তাঁদের এই উদ্যোগ।

২৯ বছর বয়সী শামিমার আব্বা-মা এবং আত্মীয়-পরিজনেরা উচ্ছ্বসিত তাঁদের মেয়ের এই অসাধারণ অর্জনে। পিএইচডি– অধ্যাপনা– নেচারের ট্রাভেল গ্রান্ট—এতসব সাফল্য অবশ্য মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারেনি শামিমার। এখনও তিনি আগের মতো মৃদুভাষী, বিনয়ী, জ্ঞান অর্জনে অসীম আগ্রহী। পাশাপাশি অল্প বয়স থেকেই তিনি যেমন যথাসাধ্য ইসলাম ধর্ম মেনে চলেন, এখনও তা বজায় রেখেছেন। চরম ব্যস্ততার মাঝেও দিনে পাঁচবার নামায পড়েন শামিমা। শালীন পোশাক ‘হিজাব’ ব্যবহার করেন।

শামিমা জানাচ্ছেন, ‘আমি নিজ রাজ্যে ফিরতে চাই। পশ্চিমবঙ্গে একটি সরকারি চাকরি পেলেই সেটা সম্ভব হবে। এখন আমি আলিগড়ে শিক্ষকতা করছি।’ গ্রামে-গঞ্জে নারী-শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করতেও চান বলে জানান তিনি।

মেয়েদের উদ্দেশে বিশেষ কোনও বার্তা? শামিমা বলছেন, ‘আত্মসম্মান বোধ, অধ্যাবসায়, প্রকৃত শিক্ষা মেয়েদের এগিয়ে দিতে পারে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে। আত্মসম্মান বোধ না থাকলে তোমার জীবনে কেউ পরিবর্তন আনতে পারবে না। তাই মেয়েদের বলব, নিজেদের জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনতে প্রস্তুতি শুরু করো এখনই! নিজেই গড়ো নিজের জীবন।’ (source: পুবের কলম)

বার্তা কক্ষ, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

Share