ফিচার

টেলিভিশন সাংবাদিকতার কৌশল

টেলিভিশন সাংবাদিকতা নিয়ে বাংলায় তেমন কোন বই নেই। যে কয়টা বই আছে তাতে শুধু তত্ত্বীয় আলোচনা, প্র্যাকটিক্যাল দিকগুলো নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। আর তাই বরাবরাই টেলিভিশন সাংবাদিকতায় প্রায়োগিক দিকগুলো অধরাই থেকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যয়নের পর প্র্যাকটিক্যালি মাঠে কাজ করতে এসে এ বিষয়টি হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছি।

মূলত যারা সেসব বইয়ের লেখক এবং যাঁরা ওই বই অনুসরণ করে আমাদের পাঠদান করেছেন তারা নিজেরাও কখনও টেলিভিশন সাংবাদিকতার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। যে কারণে থিওরেটিক্যাল সাংবাদিকতা ও প্র্যাকটিক্যাল সাংবাদিকতার মধ্যে একটি যোজন-যোজন দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

পাঁচ বছর আগে যখন টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন এ দুটি বিষয়ের দুরত্ব দেখে নিজের মধ্যে যেমন হতাশা তৈরি হয় তেমনি অবচেতনভাবেই মহামান্য শিক্ষকদের প্রতিও কিছুটা ক্ষোভ জন্মায়। কেননা বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে টেলিভিশন সাংবাদিকতার কোর্সটি পড়িয়ে তাঁরা নিজেরা যেমন অন্ধকারে ছিলেন, তেমনি বাস্তবতার সাথে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও দূরত্ব তৈরি করেছেন।

মোটকথা, থিওরি এবং প্র্যাকটিক্যালের মধ্যে সংযোগটি হয়নি। পরবর্তীতে অনেক সময় নিয়ে ফিল্ডে কাজ করে বিষয়টি শিখতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু সাংবাদিকতায় পড়া শিক্ষার্থীদেরতো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল না !

যে সময়টায় ফিল্ডে গিয়ে এক্সক্লুসিভ কোন সংবাদ বের করে আনার কথা ছিল, সে সময়টাতে তাকে থিওরি এবং প্র্যাকটিক্যালের মধ্যে সংযোগ ঘটানোতে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত এ পেশায় আসা নতুনদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে প্রচন্ড ক্ষোভ এবং হতাশা। তাদের ক্ষোভ এবং হতাশা পরবর্তী যে বিরল অভিজ্ঞতা তা নিয়েই এ পেশার সাথে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে। যারা এ বিরুপ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারছেনা তারা ছিটকে পড়ছে সাংবাদিকতা পেশা থেকে।

টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নিজের প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা এবং ভালবাসার যে সংমিশ্রণ ঘটেছে তা থেকেই এ বিষয়ে লেখার তাড়নাবোধ করছি। আশা করি ভবিষ্যৎ টেলিভিশন সাংবাদিকতায় আগ্রহীরা এটা থেকে কিছুটা ধারণা এবং দিকনির্দেশনা পাবে।

প্রথমেই টেলিভিশন সাংবাদিকতার কিছু অপরিহার্য বিষয়ের সাথে পরিচিত হওয়া যাক-

প্যাকেজ: প্যাকেজ হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ প্রতিবেদন। যেকোন একটি সংবাদগল্পের পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা হয় প্যাকেজে। যা দেখে দর্শক বিষয়টি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পান।

প্যাকেজে রিপোর্টারের ভয়েজ (কণ্ঠস্বর) থাকে। রিপোর্টার তার নিজের কণ্ঠে ঘটনার বর্ণনা দেন। আর বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে ওই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য (ভক্সপপ, সিংক) থাকে। যা দেখে ঘটনাটি সম্পর্কে ধারণা পান দর্শক। যেকোন একটি প্যাকেজের প্রধান তিনটি অংশ হচ্ছে (লিংক, ভয়েজওভার, পে অফ)।

এছাড়াও প্রয়োজনমাফিক একটি প্যাকেজে সাউন্ড আপ, আপ সাউন্ড, এমবিয়্যান্ট, গ্রাফিক্স, স্টিল ফটোগ্রাফ, ফাইল ফুটেজ, এসটোন, স্ক্রল, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক (ক্রাইম এবং সফট নিউজের ক্ষেত্রে), পিটিসি ব্যবহার করা হয়। (আরও কিছু টার্মিনোলজি আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনায় যাবো)।

মোট কথা, প্রেজেন্টার লিংক ( সংবাদ সূচনা) পড়ার পর ছবি এবং শব্দের সমন্বয়ের (ভিডিও মিক্সিং) মাধ্যমে যে প্রতিবেদনটি রিপোর্টার উপস্থাপন করেন সেটিই হচ্ছে প্যাকেজ।

এবার শুধু লিংক নিয়ে আলোচনা করা যাক-

লিংক: নিউজ প্রেজেন্টার যে কয়টি লাইনের মাধ্যমে দর্শককে একজন রিপোর্টারের রিপোর্টের সাথে সংযোগ ঘটান সেটাই লিংক। সাধারণত একজন নিউজ প্রেজেন্টার কখনও পুরো সংবাদ বলেন না। সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ পড়ার পর বলে দেন বিস্তারিত রাকিব হাসানের / শারমিন আক্তারের রিপোর্টে ।

মূলত যেকোন রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরে পুরো সংবাদের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় দর্শককে। ছোট ছোট বাক্য এবং শব্দে রিপোর্টের একটি সারমর্ম তুলে ধরা হয় এই অংশে, যেন রিপোর্টারের মূল রিপোর্টটি দেখতে আকৃষ্ট হয় দর্শক ।

পত্রিকায় যেমন শিরোনাম দেখে পাঠক সংবাদটি পড়ার সিদ্ধান্ত নেন, ঠিক তেমনি লিংকের অংশটুকু শোনার পর দর্শক রিপোর্টের বাকিটুকু দেখার জন্য জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক কথায় সরাসরি দর্শকের সাথে রিপোর্টের সংযোগ ঘটায় লিংক। লিংক শুনে আকৃষ্ট না হলে যেকোন দর্শক অন্য চ্যানেলের সংবাদে চলে যেতে পারে। এজন্য লিংক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

লিংক লেখার অপরিহার্য দিক-

সাংবাদিকতার নিয়ম অনুযায়ী কে, কি, কখন, কোথায়, কাকে, কেন, কীভাবে- এ প্রশ্নগুলোর উত্তর লিংকে চলে আসবে। দর্শককে সংবাদটি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেবে লিংক। যেহেতু সব বয়সী মানুষের কাছে সংবাদটি যাবে সেহেতু সহজ-সরল-প্রাঞ্জল শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহারে জোর দিতে হবে।

প্রতিটি প্রতিবেদনের লিংক দেখে যেকোন টেলিভিশন চ্যানেলের সম্পাদনা পর্ষদ শিরোনাম ঠিক করেন। সেকারণে লিংকে যথাযথভাবে রিপোর্টের সারমর্মটি উপস্থাপন করা হচ্ছে কিনা এ বিষয়টিতে সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

কযেকটি লিংকের উদাহরণ নিচে দেয়া হল-

উদাহরণ ১. নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ অপহৃত সাত হত্যার ঘটনায় মামলার প্রধান আসামী ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি মাইক্রোবাস ও বেশকিছু আলামতসহ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। প্রায় চারঘন্টা অভিযান চালিয়েও পাওয়া যায়নি অভিযুক্ত নূর হোসেনকে। মামলার তদন্তের স্বার্থে আটকের সংখ্যা ও জব্দ আলামতের তালিকা প্রকাশ করেনি পুলিশ। এদিকে, হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে রোববারের হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ করেছে জেলা আইনজীবী সমিতি। বিস্তারিত সাইদুল ইসলামের রিপের্টে ।

উদাহরণ ২. রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সাথে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত হয়ে পড়ার ঘটনায় দেশে গুম ও অপহরণ বেড়ে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা। অতিরিক্ত দলিয়করণের ফলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা। নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় জড়িতদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি বিশিষ্টজনদের। রাকিব হাসানের রিপোর্ট।

উদাহরণ ৩. কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই রাজধানীর ফুটপাতে নির্বিঘনে চলছে মোটর সাইকেল। আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে পথচারীদের। যদিও ট্রাফিক বিভাগ বলছে, শুধু আইন নয়, সচেতনতার মাধ্যমেই এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। আলমগীর হোসেনের ক্যামেরায় রাকিব হাসানের ধারাবাহিক রিপোর্টের প্রথম পর্ব আজ।

 রাকিব হাসান | আপডেট: ১২:৩৫ অপরাহ্ণ, ৩১ আগস্ট ২০১৫, সোমবার

 

Share