সারাদেশ

প্রেম করে বিয়ে ‘গরীবের মেয়ে’খোঁটা দিয়ে ঝিলিকের ওপর চলতো নির্যাতন

রাজধানীর গুলশানের বাসায় গৃহবধূ হাসনা হেনা ঝিলিক হত্যার ঘটনায় পুলিশ তার স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়িকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত স্বামী সাকিব আলম মিশুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

এর আগে শনিবার রাতে নিহত ঝিলিকের মা তাহমিনা হোসেন আসমা বাদী হয়ে গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে ঝিলিকের স্বামী, শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম, শাশুড়ি সাঈদা আলম, মিশুর ছোট ভাই ফাহিম ও ফাহিমের স্ত্রী টুকটুকিকে।

মামলার আসামি ফাহিম ও তার স্ত্রী টুকটুকি করোনা আক্রান্ত বলে তাদেরকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। রবিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে ঝিলিকের লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরের একটি কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। আর ঝিলিকের ৯ মাসের সন্তান আয়মানকে মিশুর বোনের কাছে দেখভালের জন্য দিয়েছে পুলিশ।

গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান বলেন, মামলা দায়েরের পরপর আমরা মিশুকে গ্রেফতার দেখাই। এছাড়া গুলশান-২ নম্বরের ৩৬ নম্বর সড়কের ২২/সি নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে মিশুর বাবা ও মাকে গ্রেফতার করা হয়। রবিবার ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে মিশুকে আদালতে পাঠানো হয়। রিমান্ড শুনানি শেষে আদালত মিশুর ৩ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করে। মিশুর বাবা ও মাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয় আদালত।

পুলিশ জানায়, ধনীর দুলাল সাকিব আলম মিশু মাদকাসক্ত ছিলেন। গুলশানের নিজেদের ফ্ল্যাটে মিশু, তার ব্যবসায়ী বাবা জাহাঙ্গীর আলম, মা সাইদা আলম, ছোট ভাই ফাহিম আলম ও ফাহিমের স্ত্রী টুকটুকি বসবাস করেন। বাসায় সার্বক্ষণিক থাকেন দুইজন গৃহকর্মী। ঝিলিকের বাবা আনোয়ার হোসেন খান কয়েক মাস আগে মারা যান। আনোয়ার হোসেন খান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট পদে কর্মরত ছিলেন। ঝিলিকরা তিন বোন ও এক ভাই। বোনদের মধ্যে ঝিলিক ছোট। তাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে তারা ৩০ বছর ভাড়া বাসায় বসবাস করছেন। ঝিলিক মোহাম্মদপুর গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে মিশুর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় তার। পরে প্রেম হয়। মিশু বাবা-মায়ের কাছে পছন্দের বিষয়টি জানালে তারা ঝিলিকের পারিবারিক বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বিয়েতে অমত দেন। কারণ, ঝিলিক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মিশু ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। মিশু তাকে ছাড়া অন্য মেয়েকে বিয়ে করবেন না বলে জানিয়ে দেন।

একপর্যায়ে ছেলের পছন্দ অনুযায়ী ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। কয়েক মাস তারা ভালোই ছিলেন। ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে শুরু হয় অশান্তি। বিয়ের পর মিশুর বাবা-মা ও ভাইবোন নির্যাতন শুরু করেন। উঠতে-বসতে তারা ঝিলিককে ‘গরিবের মেয়ে’ বলে গালমন্দ করতেন। নির্যাতনও করা হতো। মিশুর ছোট ভাই ফাহিমের স্ত্রী টুকটুকি ছিলেন উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। ২০১৯ সালের জুনে ঝিলিককে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। মাদকাসক্ত ও বেকার যুবক মিশু প্রায়ই ঝিলিককে মারপিট করতেন। দেড় মাস পর আগস্টের শুরুর দিকে মিশুকে খিলগাঁওয়ের একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়। এ খবর পেয়ে ঝিলিক তাজমহল রোডের বাবার বাসা থেকে গুলশানে শ্বশুরবাড়িতে যান। কিন্তু শাশুড়ি তাকে বাসায় ঢুকতে দেননি।

পরে ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানান ঝিলিক। গুলশান থানা পুলিশ সেখানে যায়। তবে শাশুড়ির বাধার মুখে তাকে বাসায় ঢোকাতে পারেনি পুলিশ। ২৪ দিনের মাথায় ঝিলিক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র থেকে স্বামীকে নিয়ে গুলশানের শ্বশুরবাড়িতে ওঠেন। এরই মধ্যে ঝিলিক অন্তঃসত্ত্বা হন। ঝিলিকের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ঝিলিককে বাসা থেকে আবারও বের করে দেয়। এ দফায় ঝিলিক লালমাটিয়ায় একটি মানবাধিকার সংস্থার মাধ্যমে মহিলা অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। তাদের মধ্যস্থতায় ২০২০ সালের মার্চে ঝিলিককে শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই করিয়ে দেয়। ওই বছরের জুলাইয়ে তার কোলজুড়ে নেমে আসে আয়মান নামে ফুটফুটে সন্তান। কোলে ৯ মাসের দুধের সন্তান থাকার পরও ঝিলিকের ওপর নির্যাতন থামেনি বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে।

পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী জানান, এরই মধ্যে বাড়ির একাধিক বাসিন্দা ও মিশুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গৃহকর্মীরা জানান, শুক্রবার রাতে স্বামী-স্ত্রীর প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছিল। ওই রাতেই নির্যাতন চালানোর ফলে বাসার ভিতরে মিশুর মৃত্যু হয়। পরে পারিবারিকভাবে বুদ্ধি পরামর্শ করে মিশু বিষয়টিকে দুর্ঘটনা বলে সাজানোর চেষ্টা করে।

ঢাকা ব্যুরো চীফ,৫ এপ্রিল ২০২১

Share