ঝটিকা ভ্রমণে চাঁদপুরে

সময়ের অভাবে কোথাও যেতে পারছেন না? তাহলে কোনো চিন্তা নেই। কোনো এক ছুটির দিন ঝটিকা সফরে বেরিয়ে পড়ুন চাঁদপুরের দিকে। সড়ক ও নৌপথ— দুভাবেই যাওয়া যায় চাঁদপুরে। সেখানে যাওয়ার পরে সারা দিন বা আধা বেলার জন্য অটোরিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা রিজার্ভ করে নিন। খুব কম খরচ ও সময়ে একেবারে নির্ভেজাল ভ্রমণের আনন্দ পাওয়া যাবে।

যাহোক, আমার গল্প বলি। রাত ১০টায় ঢাকার লালকুঠি নৌ টার্মিনালে ভ্রমণসঙ্গীরা হাজির। কিন্তু একজন গাবতলী বেড়িবাঁধের জ্যামে আটকা! তাই রাত ১২টার পরে শেষ জাহাজে চড়তে হলো চাঁদপুরের উদ্দেশে। আবহাওয়ার বার্তায় ছিল ৩ নম্বর সতর্কসংকেত। সেসব বার্তা থোড়াই কেয়ার করে জাহাজের ডেকে বসে গেলাম আয়েশি ভঙ্গিতে। ডেকের চেয়ারে বসে নানান রঙের মানুষ দেখি। জাহাজ চলছে। নদীর পানিতে চোখ রাখতেই দেখি ইলিশ শিকারিদের ডিঙিনৌকায় লন্ঠন জ্বলছে।

রাত চারটার আগেই চাঁদপুর ঘাটে ভিড়ল জাহাজ। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, সকাল ৭টা পর্যন্ত জাহাজ ঘাটেই থাকবে। ব্যস, ওখানেই পলিথিন বিছিয়ে চিৎপটাং।

দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের নারকেলবাগানের দৃশ্য দৃষ্টিনন্দন। সেখান থেকে যাই বঙ্গবন্ধু পার্কে। ঢুকেই ইলিশের প্রতিকৃতি চোখে পড়ল। প্রায় এক যুগ পরে দেখা চাঁদপুরের অনেক কিছুই বদলে গেছে। ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে আরেকটু এগোই। চোখে পড়ে চাঁদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ‘রক্তধারা’। আরেকটু এগোলেই নদী। তার তীরে গিয়ে বসি। জায়গাটা পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া—এই তিন নদীর মোহনা। স্থানীয় লোকজন জায়গাটাকে ‘ঠোডা’ নামে ডাকে। এর মূল নাম মোলহেড।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ‘রক্তধারা’।

এখানকার প্রকৃতি যেমন সুন্দর, তেমনি ভয়ংকর। তিন নদীর মিলনে এখানকার একটি অংশে চরমভাবে পানির ঘূর্ণন সৃষ্টি হয়।শোনা যায়, একবার ‘ঈগল’ নামের একটি যাত্রীবাহী জাহাজ এই ঘূর্ণিতে পড়ে ডুবে গিয়েছিল। সেটার হদিস আর মেলেনি!

ফরিদগঞ্জের রূপসা জমিদার বাড়ির উদ্দেশে বড় স্টেশন থেকে আধা বেলার জন্য অটোরিকশা রিজার্ভ করা হলো। এ পথে চোখে পড়বে ডাকাতিয়া নদীতীরের সারি সারি তালগাছের নান্দনিক সৌন্দর্য। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছালাম রূপসা জমিদারবাড়ির প্রধান ফটকে। এখানে ঢুকতেই প্রথমে পড়বে জমিদার বংশের সমাধিস্থল। এরপর শানবাঁধানো বিশাল পুকুর। আরেকটু সামনে যাওয়ার পর বিশাল উঠোন। সেখানেই কালের সাক্ষী হয়ে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জমিদার আহম্মদ রাজার দোতলা বাড়ি। তিনিই রূপসা জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে মুহাম্মদ গাজী জমিদারি গ্রহণ করেন। বাড়িটির বয়স প্রায় ২৫০ বছর। ঘুরে ঘুরে বাড়ির ভেতর-বাহির অবলোকন করতে থাকি।

ফরিদগঞ্জের রূপসা জমিদারবাড়ি প্রায় ২৫০ বছরের পুরোনো।

এখনো বসবাসের উপযোগী বাড়িটিতে জমিদার বংশের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই থাকেন। মোট তিনটি পাকা ভবন রয়েছে। টিনের ঘরও আছে। বাড়িটির স্থাপত্যশৈলী চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধে ফরিদগঞ্জের রূপসা জমিদারবাড়ির জমিদার বংশধরদের বেশ অবদান রয়েছে। এই জমিদার পরিবারেরই সন্তান খান বাহাদুর মুহাম্মদ আবিদুর রেজা চৌধুরী, যিনি ব্রিটিশ শাসনামলে নামকরা রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী ছিলেন।

জমিদারবাড়ি থেকে বের হয়ে ছুটলাম হরিণা ঘাটের দিকে। দুপুর ১২টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ঘাটে ইলিশের দাম শুনলাম প্রতি কেজি তিন হাজার টাকা! মাছ না কিনেই লক্ষ্মীপুর গ্রামের পথে এগিয়ে চলি। সেখানে আছে সুন্দর অবকাঠামোয় তৈরি শাহাবুদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ।

স্কুলটি দিন দিন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। পাশে থাকা মসজিদটির স্থাপত্যও বেশ নজরকাড়া। স্কুল আর মসজিদ দেখে আমরা ছুটলাম হরিণার পথে।

চাঁদপুর এসেছি, অথচ ইলিশ খাব না, তা কি হয় নাকি! বহু নাটকের পর একটি ইলিশ সংগ্রহ করে স্থানীয় এক রেস্টুরেন্টে খাওয়ার আয়োজন করা হলো। সঙ্গে চাঁদপুরের বিখ্যাত ‘ওয়ান মিনিট’ আইসক্রিম। তারপর আবার অটোরিকশায় চেপে বসা। উত্তর ও দক্ষিণ মতলবের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পড়ন্ত বিকেলে উপস্থিত হই মেঘনার তীরে। ঝাঁপ দিই প্রমত্তা মেঘনায়। ইচ্ছেমতো ডুবসাঁতার শেষে বেলতলী বেড়িবাঁধ ধরে কুমিল্লার দাউদকান্দি হয়ে ঢাকার পথ ধরি। – সূত্র: আজকের পত্রিকা

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম, ১৬ মার্চ ২০২৩

Share