বিনোদন

সরে দাঁড়াবেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা

সারা দেশে ৭০-৮০টি আসনে আওয়ামী লীগের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে প্রায় অর্ধশত প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে শেষ পর্যন্ত তিন-চারটি আসন ছাড়া অন্যগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন না। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই সরে দাঁড়াবেন বেশির ভাগ প্রার্থী। মঙ্গলবার স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

এদিকে যেসব আসনে আওয়ামী লীগ একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে সেগুলোতে দু-এক দিনের মধ্যেই একজন ছাড়া অন্যদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে আওয়ামী লীগ। দলটির কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা এমনটা জানিয়েছেন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে জয় পেতে দলকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে কঠোর অবস্থানে থাকবে আওয়ামী লীগ। সংগঠনের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আজীবন বহিষ্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গণভবনে ডেকে এই কঠোর মনোভাবের কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও একাধিক অনুষ্ঠানে এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গতকাল বুধবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও তিনি এই হুঁশিয়ারি পুনর্ব্যক্ত করেন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘৯ তারিখ মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করা হবে।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিদ্রোহীদের বিষয়ে আমাদের দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যে বার্তা দিয়েছেন, যে অবস্থান জানিয়েছেন তার বাইরে আর কোনো কথা নেই।’ সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বিদ্রোহী হলে আজীবন বহিষ্কার। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।’

জানা গেছে, ৭০ থেকে ৮০টি আসনে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন তাঁদের অনেকেরই মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে। মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে ৪৫-৫০ জনের মতো প্রার্থীর। তাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা কাজটি করবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ইতিমধ্যে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। যেহেতু ৯ তারিখ পর্যন্ত সময় আছে; সুতরাং অনেকেই চেষ্টা করছেন দলের মনোনয়ন পরিবর্তন হয় কি না তা দেখার জন্য। কেউ আশায় আছেন মহাজোটের সমীকরণে কোনো পরিবর্তন হয় কি না। ৯ তারিখের আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সবাই মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন বলে আশা করছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা।

খুলনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য পঞ্চানন বিশ্বাস। এখানে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ননীগোপাল মণ্ডল। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ননীগোপালের ভোট করার সম্ভাবনা কম। জানতে চাইলে ননীগোপাল মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী থাকলে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব না। তবে মহাজোটের অন্য কোনো দলের কেউ মনোনয়ন পেলে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে।’

মেহেরপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য জয়নাল আবেদীন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে দলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী আছে। যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নেই। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার আত্মীয় হওয়ার কারণে তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন।’

শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন কি না জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করব। আগে প্রতীক বরাদ্দ হোক। এরপর আমার পক্ষে যেসব নেতাকর্মী কাজ করছে তাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেব।’

লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সাত্তার। তবে তিনি শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে জানা গেছে।

ময়মনসিংহ-৯ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন নান্দাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুস সালাম। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে থাকবেন না বলে মনে করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা।

পিরোজপুর-৩ আসনটি মহাজোটের সমীকরণে বর্তমান সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের দুই নেতা—উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগকারী আশরাফুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন। তবে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তাঁদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা কম।

রংপুর-৩ আসনটি ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলীকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ইমদাদুল হক। তাঁর পক্ষে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমেছে। স্থানীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দলের সিদ্ধান্ত পক্ষে না এলে ইমদাদুল শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়াবেন।

চট্টগ্রাম-২ আসনটি ১৪ দলের শরিক তরীকতকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফটিকছড়ির জনগণের চাপে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। আমরা আশায় আছি আসনটিতে নৌকার প্রার্থী পরিবর্তন হবে। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সভাপতি যে নির্দেশ দেবেন সেটাই মেনে নেব।’

ফেনী-১ আসনটি এবারও জাসদকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খাইরুল বাশার মজুমদার। দলের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বাশার শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নেবেন।

ফেনী-৩ আসন জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে আসনটিতে শোডাউন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবুল বাশার। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকব। এখানকার মানুষ লাঙলে ভোট দিতে চায় না। ফলে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।’

তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত বাশার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

নেত্রকোনা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী। তিনিও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন বলে ধারণা স্থানীয় নেতাকর্মীদের।

বিদ্রোহী প্রার্থী থাকতে পারেন যেসব আসনে : পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ আউয়াল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মী রেজাউলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তার পরও শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে থেকে যেতে পারেন আউয়াল। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দল মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করতে আউয়ালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে।

নরসিংদী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জহিরুল হক ভূঞা মোহন। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লা। তিনি গত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহনকে পরাজিত করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, সিরাজুল এবারও নির্বাচনের মাঠ ছাড়বেন না।

মেহেরপুর-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেন। তিনি এখানে দুইবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়ী হন। এবারও তাঁর সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম।

জানতে চাইলে মঙ্গলবার মকবুল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আজ এ বিষয়ে বলতে পারছি না। আগামীকাল স্পষ্ট করতে পারব।’ তবে গতকাল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

প্রতিবেদনে মাঠপর্যায়ের সার্বিক তথ্য পাঠিয়েছেন ফেনী, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, মেহেরপুর ও ময়মনসিংহ প্রতিনিধি এবং চট্টগ্রাম, রংপুর ও খুলনা অফিস। (কালের কণ্ঠ)

বর্তা কক্ষ
০৬ ডিসেম্বর,২০১৮

Share