বান্দাগণের ওপর মহান প্রভুর অন্যতম একটি অনুগ্রহ এই যে, তাদের জন্য তিনি ইবাদতের বিশেষ কিছু মওসুম নির্ধারিত করে দিয়েছেন। যাতে করে বান্দা ওইসব মওসুমে নিজের আমল বৃদ্ধি করে এবং আপন মাওলার নৈকট্য লাভের আশায় প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। প্রকৃত সৌভাগ্যবান সেই, যে ওইসব মওসুমকে গনিমত মনে করে যথাযথ মূল্যায়নের চেষ্টা করে। এমনসব বিশেষ মওসুমের মধ্য থেকে একটি হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশদিন। পবিত্র কোরআন ও সুন্নায় এই দিনগুলোর ফজিলত বহুভাবে বিধৃত হয়েছে।
কীভাবে স্বাগতম জানাবো?
একজন সত্যিকার মুসলমানের জন্য উচিত হলো, আল্লাহ প্রদত্ত ইবাদতের বিশেষ মওসুমগুলোর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং যথোপযুক্ত উপায়ে মওসুমগুলোকে স্বাগতম জানানো। সুতরাং জিলহজের বরকতময় এই দশদিনকেও আমরা বিভিন্নভাবে স্বাগতম জানাতে পারি।
এক. তওবা। ইবাদতের ফজিলতপূর্ণ মওসুম শুরু হওয়ার আগেই সঠিকভাবে তওবা এবং আল্লাহর প্রতি ফিরে আসার দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা করা বাঞ্চণীয়। বস্তুত তওবার মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাতের সমূহ কল্যাণ নিহিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মোমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা আন-নূর: ৩১)
দুই. দৃঢ় সংকল্প। নেক আমল ও পুণ্যমহিমা দ্বারা বিশেষ মুহূর্তগুলো কাজে লাগানোর দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা দরকার। আল্লাহর পথে যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে আল্লাহ তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার রাস্তাগুলো সহজ করে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব।’ (সূরা আল আনকাবুত: ৬৯)
তিন. পাপকাজ থেকে দূরত্ব। নেক আমল যেভাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম, তেমনি পাপকাজ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণ। অতএব নেক আমল করে ইবাদতের বিশেষ মওসুমগুলো থেকে উপকৃত হওয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো নিজেকে সবরকমের অন্যায়-অশ্লীল এবং যাবতীয় গোনাহের কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখা।
জিলহজের প্রথম দশদিনের ফজিলত
১. পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এই দশদিনের নামে শপথ করেছেন। আর আল্লাহ যদি কোনোকিছুর নামে শপথ করে নেন তাহলে সেটা অনেক গুরুত্ববহ ও তাৎপর্যময় হয়ে থাকে। কেননা মহান সত্ত্বা মহান কিছু ব্যতীত শপথ করবেন না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শপথ ফজরের। শপথ দশ রাত্রির।’ (সূরা আল ফজর: ১-২) নির্ভরযোগ্য সকল তাফসিরবিদের মতে এই দশ রাত্রি বলে জিলহজের প্রথম দশদিনই উদ্দেশ্য। হাফিজ ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, এটিই হচ্ছে বিশুদ্ধ অভিমত। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৪/৪১৩)
২. আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেয়া চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়।’ (সূরা হাজ্জ্ব: ২৮) ইবনে ওমর (রা.), ইবনে আব্বাস (রা.) প্রমুখ সাহাবি ও তৎপরবর্তী মনীষীর মতে এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলে জিলহজের প্রথম দশদিনকে বোঝানো হয়েছে।
৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধিক হাদিসে এই দিনগুলোর ফজিলত ও বিশেষত্ব বলে দিয়েছেন। তিনি এই দিনগুলোকে শ্রেষ্ঠতম দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, ‘জিলহজের এই দিনগুলোতে নেক আমল আল্লাহর নিকট যত প্রিয়, অন্য কোনো দিনে তত প্রিয় নয়। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এমনকি আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়েও (প্রিয়)? নবী বললেন, হ্যাঁ আল্লাহর পথে জিহাদের চেয়েও, তবে যদি কোনো ব্যক্তি নিজের জান ও মাল নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদে বের অতঃপর এসবের কিছুই নিয়ে না ফিরে।’ (বোখারি: ৯৬৯)
তাছাড়া চিন্তা করে দেখুন! এই দশদিনের ভেতরই হলো আরাফার দিন; যেইদিনের গুরুত্ব, মর্যাদা এবং রোজা রাখার ফজিলত সর্বজনবিদিত। তেমনি এই দশদিনের ভেতরেই হলো কোরবানির মহান দিন। হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) কতইনা সুন্দর বলেছেন যে, জিলহজের প্রথম দশদিনের বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্যের যে কারণ আমার বোধগম্য হয় তা হলো এই যে, এদিনগুলোতে ইসলামের মৌলিক সবকটি ইবাদতের সম্মিলন ঘটে যাওয়া যেমন নামাজ, রোজা, হজ ও সদকা। বস্তুত এছাড়া অন্য কোনো সময় এতগুলো ইবাদত একত্রিত হয় না। (ফাতহুল বারি)
এই দিনগুলোর বিশেষ আমল
ক. সামর্থ্যবানদের ওপর তো হজ ফরজ। সুতরাং এই দিনগুলোতে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ হলো হজ ও ওমরাহর করণীয়সমূহ আঞ্জাম দেয়া। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহর মধ্যবর্তী সময়ের (সগিরা) পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর জান্নাতই হচ্ছে মকবুল হজের একমাত্র প্রতিদান।’ (সহিহ বোখারি: ১৭৭৩, সহিহ মুসলিম: ৪৩৭)
খ. রোজা রাখা। জিলহজের প্রথম দিনই রোজা রাখা সওয়াবের কাজ। বিশেষ করে নয় তারিখ তথা আরাফার দিনে রোজা রাখার বিশেষ সওয়াব রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে আরাফার দিনের রোজা রাখল অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তার একবছর পূর্বের এবং একবছর পরের তথা দুই বছরের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (মুসলিম: ১৯৭) তবে যারা হজ আদায়ে ওইদিন আরাফায় থাকবেন তাদের জন্য এই বিধান নয়। তারা বরং রোজা না রাখাটাই শ্রেয়। কেননা নবী (সা.) আরাফায় থেকে এই রোজা রাখেন নি।
গ. তাকবির ইত্যাদি বেশি বেশি পড়া। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত এবিষয়ক এক হাদিসে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, অতএব তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) এবং তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) পড়বে। (মুসনাদে আহমাদ, ৭/২২৪) ইমাম বোখারি (রহ.) বলেন, ইবনে ওমর (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) এই দিনগুলোতে বাজারে যেতেন এবং বেশি বেশি তাকবির বলতেন; যাতে লোকেরা তাদের থেকে শিখতে পারে।
ঘ. সদকা করা। এমনিতেই সদকা একটি মহৎ ও সওয়াবের কাজ। তদুপরি বরকতময় দিনগুলোতে আরও বেশি সদকা করা উচিত। সদকার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত জালেম।’ (সূরা আল বাক্বারাহ: ২৫৪) প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘সদকার কারণে সম্পদ হৃাস পায় না।’ (মুসলিম: ২৫৮৮)
মোটকথা, বরকতময় এই দিনগুলোকে সমূহ নেক আমল যেমন নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, দরূদ, ইস্তিগফার, মানবসেবা, পরোপকার ইত্যাকার পুণ্যকাজের দ্বারা কাজে লাগানোই প্রকৃত মুসলমানের অভীষ্ট লক্ষ্য হওয়া চাই।
লেখক : আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন