গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে দেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। লাভজনক হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠে অনেকগুলো ইয়ার্ড। সেখানে বিদেশ থেকে নানা ধরনের পুরনো জাহাজ এনে ভাঙতে থাকেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে খুব একটা কড়াকড়ি না থাকায় অন্যান্য জাহাজের সঙ্গে অয়েল ট্যাংকারও আসতে থাকে এসব ইয়ার্ডে। ফলে বর্তমানে অনেকটাই বিদেশী অয়েল ট্যাংকের ডাম্পিং স্টেশনে পরিণত হয়েছে চট্টগ্রামের শিপইয়ার্ডগুলো। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ক্লার্কসন্স রিসার্চের গবেষণা বলছে, জাহাজ ভাঙায় বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর দেশে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বের ৬৪ শতাংশ অয়েল ট্যাংকার এখন বাংলাদেশেই পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অয়েল ট্যাংকারগুলোয় প্রচুর পরিমাণে পরিবাহিত জ্বালানি তেলের বর্জ্য বা গাদ, অ্যাসবেসটস ও পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল (পিসিবি) থাকে।
এগুলোর সবই পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত ও ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচিত। এ কারণে প্রতিবেদনগুলোয় ভারত, বাংলাদেশ বা পরিবেশগতভাবে নাজুক অবস্থানে থাকা অন্যান্য এশীয় দেশে অয়েল ট্যাংকার ভাঙতে না পাঠানোর সুপারিশ রয়েছে।
এসব সুপারিশ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে ভাঙা অয়েল ট্যাংকারগুলো থেকে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত উপাদানে বায়ু ও পানি দূষিত হচ্ছে। এসব জাহাজে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান অ্যাসবেসটস নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় অনেকখানি। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের জীববৈচিত্র্য। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় জাহাজ ভাঙার কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে নাজুক অবস্থানে পড়ে গিয়েছে সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল বনাঞ্চলও। একই সঙ্গে তা ক্ষতিগ্রস্ত করছে সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকাকে। বিশেষ করে জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে ভাঙার জন্য আনা জাহাজগুলোর মধ্যে অয়েল ট্যাংকার ছাড়াও রয়েছে বাল্ক ক্যারিয়ার, কেমিক্যাল ট্যাংকারস, কনটেইনার শিপস, ফেরিজ অ্যান্ড প্যাসেঞ্জার শিপস, জেনারেল কার্গো শিপস, লিকুইফায়েড গ্যাস ক্যারিয়ারস, অফশোর ভেসেলস ও অন্যান্য।
ক্লার্কসন্স রিসার্চের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া জাহাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল বাল্ক ক্যারিয়ার, যার পরিমাণ ৩৪ লাখ ২৬ হাজার গ্রস টন। এছাড়া কনটেইনার শিপ ছিল ১০ লাখ ১৫ হাজার গ্রস টন। আর অয়েল ট্যাংকার ছিল ১২ লাখ ৭১ হাজার গ্রস টন, যা বিশ্বের সব দেশে বিক্রি হওয়া পুরনো অয়েল ট্যাংকারের ৬৪ শতাংশ। সে হিসাবে বিশ্বের ৬৪ শতাংশ অয়েল ট্যাংকারই পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হয় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কেও পুরনো জাহাজ ভেঙে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই চারটি দেশসহ পুরো বিশ্বে ২০১৯ সালে ১ কোটি ২২ লাখ ১৮ হাজার গ্রস টন পুরনো জাহাজ বিক্রি হয়েছে। যার মধ্যে ৬৬ লাখ ৮২ হাজার গ্রস টন বা প্রায় ৫৫ শতাংশই এসেছে বাংলাদেশে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটা সময় শুধু অয়েল ট্যাংকারই আসত। এখন প্রায় সব ধরনের জাহাজই আসে। তবে সবচেয়ে বেশি আসে বাল্ক ক্যারিয়ার ও অয়েল ট্যাংকার। প্রয়োজনীয় সরকারি পরিদর্শন সাপেক্ষেই অয়েল ট্যাংকারগুলো ইয়ার্ডে নিয়ে আসার অনুমতি দেয়া হয়। করোনার প্রভাবে সাময়িকভাবে জাহাজের প্রবাহ কিছুটা কমলেও এখন জাহাজ আসছে। কর্মপরিবেশ ও শ্রম সুরক্ষা বজায় রেখেই সক্রিয় আছে ইয়ার্ডগুলো।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবু তাহের বণিক বার্তাকে বলেন, যথাযথ অনুমোদন নিয়েই এগুলো ইয়ার্ডে এনে ভাঙার কাজ করা হয়। শিল্প হিসেবে এ কাজটি বিকশিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। কর্মপরিবেশ ও শ্রমসংক্রান্ত সার্বিক কমপ্লায়েন্স বজায় রেখেই জাহাজ ভাঙা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা কমপ্লায়েন্স বজায় রেখে জাহাজ ভাঙা শিল্পের বিকাশ ঘটছে বলে দাবি করলেও পরিবেশবাদীরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশ পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় নিয়ে জাহাজ ভাঙার মতো ঝুঁকির কাজ থেকে সরে এলেও বাংলাদেশে অযৌক্তিকভাবে এ কাজকে শিল্পে পরিণত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিদেশীরা তাদের পুরনো জাহাজ আর কোথাও পাঠাতে পারে না, তাই বাংলাদেশে আর গুজরাটে পাঠায়। আগে পাঠাত পাকিস্তানে, কিন্তু তাও এখন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। আর চীনও গত বছর থেকে নিচ্ছে না, আর দুই-একটা যায় তুরস্কে। বাংলাদেশে যত ইস্পাতের কাঁচামাল প্রয়োজন তার বেশির ভাগই আসে আমদানি করা বিলেট থেকে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ভারতে জাহাজ সৈকতে ভেড়ানোর আগে ট্যাংকার মুক্ত করে নেয়ার নির্দেশনা আছে। বাংলাদেশের আদালতও একই কথা বলেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের আদালতের নির্দেশনার পরও অয়েল ট্যাংকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এছাড়া অন্যান্য জাহাজ গ্যাসমুক্ত করা গেলেও অয়েল ট্যাংকার কখনই গ্যাসমুক্ত করা যায় না। ফলে এতে পরিবেশের ক্ষতি হয় বেশি।
বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ড রয়েছে প্রায় ১৬০টি। এর মধ্যে সচল আছে ৫০-৬০টি। এসব ইয়ার্ডে কাজ করেন ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। জাহাজ সৈকতায়নের পরই ইয়ার্ডে কর্মতত্পরতা শুরু হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অভাবে এ কাজে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি অরক্ষিত ব্যবস্থায় ইয়ার্ডের শ্রমিকরাও কাজ করছেন নিরাপত্তাহীনভাবে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে ১৮ জন জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ইয়ার্ডেই মারা যান।
নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালে প্রণয়ন হয় বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ আইন। এ আইনের আওতায় একটি বোর্ড গঠনের কথা রয়েছে। যদিও আইন প্রণয়নের দুই বছরেও কোনো বোর্ড গঠন করা হয়নি।
বিশ্বের আর কোনো দেশ এভাবে লোহা ভাঙে না। বাংলাদেশে কেন এটা হয়, তা বোধগম্য নয় জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে মৃত্যুর দায় কে নেবে, সেটা যতদিন পর্যন্ত ঠিক না হয় ততদিন পর্যন্ত কাজটি চলতে দেয়া উচিত না। সরকার যখন মৃত্যুর দায় নিতে রাজি হবে, তখনই এ কাজ চলমান রাখা যেতে পারে। বিশ্বব্যাংকের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৮০ হাজার টন অ্যাজবেসটস আসবে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জাহাজ ভাঙা শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক অ্যাজবেসটসিসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। এক ফোঁটা অ্যাজবেসটস মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে গেলে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই ৮০ হাজার টনের দায়িত্ব কে নেবে, এমন প্রশ্নও রাখেন বিশেষজ্ঞরা।
গত ৯ নভেম্বর পর্যন্ত শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শিবনাথ রায়। গতকাল বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করোনার মধ্যে সার্বিক পরিদর্শন কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। শুধু জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্যই পরিদর্শক সুনির্দিষ্ট করা আছে, যারা সার্বিক কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো নিশ্চিত করে। সাম্প্রতিক সময়ে খুব নেতিবাচক কোনো প্রতিবেদন পাইনি। দুই-তিন মাসে হতাহতের ঘটনাও তেমন ঘটেনি। জাহাজ ভাঙার সার্বিক বিষয়গুলো দেখার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে, এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্পও ছিল। প্রকল্পের আওতায় অয়েল ট্যাংকার ভাঙার আগে কী কী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার, চেম্বার, গ্যাস সিলিন্ডার রিলিজ করা এ বিষয়গুলো নজরদারি করছে।
ঢাকা ব্যুরো চীফ, ১২ নভেম্বর ২০২০