ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত কি তৃতীয় বৃহত্তম দল নাকি চতুর্থ— এ নিয়ে অনেকেরই ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক ভিত্তি, অনুগত কর্মী বাহিনী এবং ইচ্ছাশক্তি ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের শক্তিমত্তাকে যদি বিবেচনা করা হয় তবে জামায়াতের অবস্থান যে দেশের সব রাজনৈতিক দল থেকে ভিন্নতর সে ব্যাপারে কেউ হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন না। স্বাধীনতার পর থেকে দলটির ওপর যে ঝড়-ঝাপটা গেছে তা অন্য কোনো দলের ওপর দিয়ে গেলে কী হতো জানি না, তবে এসব ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-বাদলে জামায়াতের রাজনৈতিক ফলন যে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অতি সতর্ক অবস্থান দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়।
জামায়াত মনে করে, তাদের ওপর মানবসৃষ্ট বালার তাণ্ডব চলছে। অন্যদিকে তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের তরুণ প্রজন্ম মনে করে একশ্রেণির জামায়াত নেতার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কট্টর অবস্থানের কারণে জামায়াতের ওপর ধেয়ে আসা বালা প্রবল শক্তিতে মুসিবতে পরিণত হয়ে তাদের ওপর আবর্তিত হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো দশমুখে প্রচার করছে যে, জামায়াত-শিবির তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছে। ১৯৭১ সালে তাদের নৃশংস ভূমিকা এবং পরবর্তীকালে ক্ষমা কিংবা অনুশোচনা না করার কারণে জামায়াতের ওপর খোদায়ী গজব নাজিল হয়েছে। লাখ লাখ ধর্ষিতার আর্তচিত্কার এবং তার চেয়েও বেশি সংখ্যক শহীদের রক্তের দায় না মেটানো পর্যন্ত জামায়াত কোনো দিন দুনিয়া এবং আখেরাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
আজকের নিবন্ধে আমি কট্টরপন্থি জামায়াত-শিবিরের মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি অথবা বিশ্বাস নিয়ে কোনো আলোচনায় যাব না। অথবা জামায়াতবিরোধীদের আপাত সাফল্য এবং হম্বিতম্বি নিয়েও মন্তব্য করব না। বরং ২০১৬ সালে এসে জামায়াতের ভূত-ভবিষ্যৎ এবং কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করব। জামায়াতবিরোধীরা এই মুহূর্তে মারাত্মক দুটি ভ্রমের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তারা জামায়াতের জানি দুশমন অন্যান্য ইসলামী সংগঠনকে জামায়াতের সহযোগী বিবেচনা করে তাদের সঙ্গেও বৈরিতায় লিপ্ত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কিংবা গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে জামায়াতের যে শত্রুতা এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ রয়েছে তার চেয়েও শতগুণ শত্রুতা তারা পোষণ করে কোনো কোনো ইসলামী সংগঠনের বিরুদ্ধে। সরকারি দলের মোটা মাথার লোকজন মাওলানা মওদুদীর কোনো বই পড়ে না কিংবা সাঈদীর ১৯৯২-২০০৮ সালের ওয়াজসমূহ শোনে না। ফলে তারা কোনো কিছু না বুঝেই জামায়াতকে নির্মূল করার রাজনৈতিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তাদের এই অপরিপক্বতার বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যেভাবে ছক কষে এগোনোর চেষ্টা করে তাতে স্পষ্টতই অসি এবং মসির শক্তিমত্তার প্রভাব জনারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রথমত দুটি কারণে জামায়াতের সঙ্গে বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়ে। প্রথম কারণটি ছিল ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার পথ তৈরির জন্য জামায়াতকে সুবিধাজনক স্থানে স্থাপন করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগ মনে করে, এ দেশের জনগণ অস্থির এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলতে ওস্তাদ। তারা স্বেচ্ছায় পরপর দুবার কোনো রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায় না। কাজেই আগামীর নির্বাচনে জয়লাভ এবং সরকার গঠনের জন্য কৌশল ও রাজনৈতিক মেরুকরণের অংশ হিসেবে তারা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ভাঙার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই দেশীয় জনমতের বিরাট অংশ সরকারের ওপর চাপ দিতে আরম্ভ করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করার জন্য। এক্ষেত্রে সরকার জামায়াতকে বাগে আনার জন্য যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রপাগান্ডা শুরু করে। সরকার মনে মনে দুটি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আশা করে প্রপাগান্ডা দিনকে দিন তীব্র থেকে তীব্রতর করতে থাকে। প্রথম আশা ছিল জামায়াত হয়তো ভয় পেয়ে যাবে এবং সুরসুর করে বিএনপি জোট ত্যাগ করে সরকারের কথামতো রাজপথে এসে রাজনৈতিক ভাঁড়ের ন্যায় সরকারবিরোধী হম্বিতম্বি শুরু করবে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধের কথা বলে জনমতকে আওয়ামী লীগের দিকে টেনে নিয়ে আসা।
২০০৯ এবং ২০১০ সালের পুরোটা সময় নিয়ে সরকার যে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালায় তাতে পুরো পরিস্থিতি তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। প্রথমত, জামায়াত-শিবির ভয় না পেয়ে উল্টো ঔদ্ধত্য আচরণ শুরু করে। প্রয়াত গোলাম আযম এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আলী আহসান মুজাহিদ বিভিন্ন টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে সাক্ষাত্কার দিয়ে ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকার পক্ষে সাফাই গান এবং সেই সময়ের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নন বলে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন। তাদের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপি একই কায়দায় তাদের পক্ষাবলম্বন করে এবং ১৯৭১ সালের সব ঘটনাকে মীমাংসিত আখ্যা দিয়ে উল্টো সরকারকে দোষারূপ করতে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার জন্য। দ্বিতীয়ত, সরকারি প্রচার-প্রপাগান্ডা এবং বিএনপি-জামায়াতের প্রতিক্রিয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্বতন্ত্র একটি জনমত গড়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, গৃহবধূ এবং নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। এসব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ক্ষমতা ভাগাভাগির দরকষাকষি না করতে পারে সে জন্য নতুন প্রজন্ম একাধিক অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে সংগঠিত হতে থাকে।
সরকারি প্রপাগান্ডায় যুদ্ধাপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে তৈরি হওয়া স্বতন্ত্র জনমত ’৭১-এর অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে ওঠে। মিরপুরের গণহত্যার ভয়ঙ্কর খলনায়ক কসাই বলে কথিত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যখন ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয় তখন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সৃষ্টি হয় গণজাগরণ মঞ্চের। সরকার প্রথম দিন থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পারে। অন্যদিকে জামায়াত-বিএনপি নেতৃত্ব বিষয়টিকে অতটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি মূল্যায়ন শুরু করে। এ অবস্থায় সরকার জামায়াতকে বাগে আনার নীতি পরিহার করে জামায়াতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংগঠনিক শক্তি নির্মূল করার নতুন পরিকল্পনার পথে পা বাড়ায়। শুরু হয়ে যায় ধরপাকড়, হুমকি-ধমকি ইত্যাদি।
সরকারের নতুন অগ্নিমূর্তির কার্যকারণের গুরুত্ব অনুধাবন করতে জামায়াত নেতৃত্ব পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। তারা তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি, কর্মী বাহিনী এবং অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ওপর যতটা না আস্থাশীল ছিল তার চেয়েও বেশি আস্থাশীল ছিল সরকারের দুর্বলতা এবং রাষ্ট্রশক্তির অক্ষমতার বিষয়ে। তারা যখন পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পারল তখন সবকিছু চলে গিয়েছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে জামায়াত পরম ধৈর্য নিয়ে খোদায়ী সাহায্য প্রার্থনা করেছে অর্থাৎ নিজেদের জন্য গায়েবী বরকত-রহমত এবং জান্নাত। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের জন্য চেয়েছে হেদায়েত, গজব এবং জাহান্নাম।
আসমানি ফয়সালার বাইরে তারা নিজেরাও কম চেষ্টা করেনি। গতানুগতিক রাজনৈতিক কর্মসূচি, হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও, কূটনীতি, অর্থব্যয়, দেশি-বিদেশি চক্রের সাহায্য গ্রহণ থেকে শুরু করে প্রথাবিরুদ্ধ গোপন কর্মও বাদ রাখেনি, তাদের অব্যাহত চেষ্টার ফলে জনগণ তো বটেই, মাঝে মধ্যে সরকারও ভয় পেয়ে যেত। এভাবেই চলছিল ২০১৫ সালের জুন-জুলাই পর্যন্ত। তারপর কোথায় কী হলো তা কেউ বলতে পারে না। দেশের পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনেই নেমে এলো কবরস্থানের মতো নীরবতা। সেই নীরবতায় দেশের অন্য বাসিন্দাদের মতো জামায়াত-শিবিরও একেবারেই চুপ হয়ে গেল। ফলে সরকার গত ৭-৮ মাস ধরে বেজায় শান্তিতে দিন কাটাতে গিয়ে একবারও ভাবল না গত সাড়ে পাঁচ বছরের ইতিহাস আগামী দিনে কী পরিণতি ডেকে আনতে পারে! তারা ধরেই নিয়েছে যে, জামায়াতি বালা এবং শিবিরি মুসিবত থেকে তারা রেহাই পেয়ে গেছে। এখন তারা যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব বাতিল এবং জামায়াত নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নে সময় পার করছে।
প্রতিষ্ঠার পর দল হিসেবে জামায়াত কোনো দিন কোনোকালে একক ক্ষমতাধর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে কোনো দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে পারেনি। উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কেবল বাংলাদেশেই তাদের অবস্থান তুলনামূলকভাবে ভালো। অন্যদিকে সৌদি আরব, মিসর, তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে তাদের সম মতাদর্শের রাজনৈতিক দল, মত এবং গোষ্ঠী অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। কোনো কোনো দেশে জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলগুলো গত একশত বছর ধরে রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রাম করে ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। জামায়াত যে মতাদর্শের রাজনীতি করে যেখানে বিশ্বব্যাপী তাদের কয়েকটি চরিত্র ফুটে উঠেছে। প্রথমত, রাজনীতি কেবল ক্ষমতা লাভের জন্য নয়। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম মেনে কোরআন এবং হাদিসের আলোকে তারা প্রাচীন জমানার খোলাফায়ে রাশেদীন এবং আধুনিককালের সৌদি আরবের মতো একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তারা ওহাবী মতবাদে বিশ্বাসী এবং মওদুদী ডকট্রিন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। ইসলাম ধর্মে তাদের মতাদর্শের বাইরে যেসব কৃষ্টি, কালচার, নিয়মনীতি এবং প্রথাসমূহ রয়েছে, তারা সর্বশক্তি দিয়ে সেসব প্রতিহত এবং রহিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়াদাবদ্ধ। রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে তারা এসব কাজে শক্তি প্রয়োগ করবে— অন্যথায় দাওয়াতি কার্যক্রমের মাধ্যমে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চেষ্টা করবে।
জামায়াত মতাদর্শের দলগুলো সারা দুনিয়ায় একই কায়দায় কর্মী বাছাই করে এবং একই প্রক্রিয়ায় নেতা নির্বাচন করে। এসব দলের কর্মী হতে হলে হয় মাসিক চাঁদা পরিশোধ করতে হবে নয়তো দল থেকে মাসিক ভাতা গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর কোথাও তারা গত আড়াইশ বছরে অর্থাৎ ওহাবীবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লগ্ন থেকে আজ অবধি নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র লড়াই কম করেনি। এই মতাদর্শের একটি রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তির খবর আজ অবধি পাওয়া যায়নি। সমাজ সংসার এবং রাষ্ট্রের বহুমুখী তাপ ও চাপে তারা মাঝে মধ্যে অনেক কিছু পরিবর্তন করেছে বটে কিন্তু হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে হারিয়ে যায়নি।
বাংলাদেশের জামায়াত দাবি করে যে, দেশের ১০ শতাংশ মানুষ তাদের রাজনীতির মতাদর্শে বিশ্বাসী। অর্থাৎ এক কোটি ৬০ লাখ লোক জামায়াতের সঙ্গে জড়িত। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যায়ে অবশ্যই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত কিংবা আগামীতে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এমন লোকের সংখ্যা সাকুল্যে কুড়িজনও হবে না। অন্যদিকে অন্তর্দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের লড়াই এবং কলহে লিপ্ত জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সংখ্যা চার-পাঁচজনের বেশি নয়। বাকিরা সবাই কায়মনোবাক্যে জামায়াতি কিংবা শিবিরি কর্মী হয়ে বেঁচে থাকতে চায় অথবা দলীয় পরিচয় নিয়েই কবরস্থানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। ফলে সরকারের বিগত দিনের নানামুখী চাপের কারণে জামায়াত-শিবিরের তৃণমূলের রাজনীতিতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে এমন খবর পাওয়া যায়নি। অথবা এ কথাও শোনা যায়নি যে, তৃণমূল নেতৃত্ব ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে খিস্তিখেউড় শুরু করেছে। এ অবস্থায় সরকার দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে নাকে দড়ি দিয়ে যেভাবে ওঠ-বস করাচ্ছে সেভাবে জামায়াতকে যে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না তা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানের দরকার নেই।
জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং ২০১৬ সালের নতুন প্রেক্ষাপট মেনে নিয়েছে। তারা অতীতের মতো সরকার এবং রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ না হয়ে বিবর্তনের নীতি গ্রহণ করেছে। তারা আপাতত চুপ থাকবে এবং নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিকে বাড়ানোর চেষ্টা করবে। তারা বিএনপির কোনো কর্মের সঙ্গে থাকবে না আবার দলটির সঙ্গে স্বউদ্যোগী হয়ে সম্পর্কও ছিন্ন করবে না। তারা মনে করছে, রাজনীতিতে অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে এবং পরিবর্তনের সেই সময়ে তারাই বেশি সুফল ঘরে তুলতে পারবে, যারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে। সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে তারা সহজভাবে গ্রহণ করবে। দল হিসেবে নিষিদ্ধকরণ এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রশাসক বসানোর সরকারি উদ্যোগে দলটি উল্টো উল্লাস প্রকাশ করছে। তাদের মতে, সরকার যদি জামায়াত নিষিদ্ধ করে তবে তারা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে সংগঠিত হতে পারবে। অন্যদিকে ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত দক্ষ জামায়াতি জনশক্তি ধীরে ধীরে সরে পড়বে এবং নতুন নামে বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে। এতে প্রতিষ্ঠিত পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এবং সরকারকে মারাত্মক ইমেজ সংকটে ফেলে দেবে।
জামায়াতের কর্মপরিকল্পনা, মনোভাব এবং আদর্শিক বিষয় সম্পর্কে সরকারের অজ্ঞতার কারণে একদিকে জামায়াত যেমন লাভবান হচ্ছে তেমনি সরকার রাষ্ট্র এবং জনগণ নিত্যনতুন সমস্যার আবর্তে জড়িয়ে পড়ছে। জামায়াতের শত্রুদের জামায়াত কর্মী মনে করে বৈরিতা পোষণের মাধ্যমে সরকার মূলত জামায়াতকেই শক্তিশালী করে তুলছে। জামায়াতে ইসলামী, জামায়াতবিরোধী ইসলামী সংগঠন এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে যদি সরকার একই কাতারে দাঁড় করায়, তবে তাদের সৃষ্ট জামায়াতি বালা এবং শিবিরি মুসিবত বুমেরাং হয়ে ত্রি-মাত্রিক শক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগের দিকে ধেয়ে আসবে। অন্যদিকে জামায়াত-শিবিরকেও বুঝতে হবে যে ১৯৭১ সালে তাদের সশস্ত্র ভূমিকা এবং ২০১৪-১৫ সালের সন্ত্রাস তাদের রাজনৈতিক আদর্শ, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান। কাজেই ২০১৬ সালে এসে তারা যদি অতীত ভুলগুলোর দায় মেটাতে না পারে, তবে মানবসৃষ্ট বালা-মুসিবত খোদায়ী গজবে পরিণত হবে।
লেখক : কলামিস্ট