জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ

আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে বাঙালি জাতির জীবনে এক বিভিষিকাময় রাত নেমে আসে। মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানানদার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মতো তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল-বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। এভাবে রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কোনো বাহিনীর আক্রমণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অতীতে বাংলাদেশে গণহত্যার দিবসটি উপেক্ষিত হলেও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে। জাতীয় সংসদে গৃহীত এক প্রস্তাবের প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সাল থেকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

যা ঘটেছিল সেদিন

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো দূরভিসন্ধি করে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। বাঙালি তখন বুঝতে পেরেছিল- স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানিদের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ স্বাধীনতার নির্দেশনা দেন। এর মধ্যেই বাঙালির ওপর সামরিক হামলার নীলনকশা চূড়ান্ত করে পাকিস্তানি বাহিনী।

২৫ মার্চ ছিল অসহযোগ আন্দোলনের ২৪তম দিন। সেদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা সাঁজোয়া ট্যাংক নিয়ে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নামে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। এর অব্যাবহিত পূর্বেই জাতির পিতা স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা বার্তা লিখে যান- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও’, যা প্রথমে ইপিআর এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মাধ্যমে এ বার্তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের মিয়াওয়ালি কারাগারে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ১৩ জুন পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস যুক্তরাজ্যের ‘দি সানডে টাইমস’ পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্মম বর্বরতার বাস্তব চিত্র নির্ভর একটি বিস্তারিত নিবন্ধ প্রকাশ করলে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি ত্বরান্বিত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারায় এবং গোটা দেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এক সময় গণহত্যার এই বিষয়টি চাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়। ১৯৭৫ সালের পর এই অপরাজনীতিতে জড়িত ছিল সামরিক-বেসামরিক আমলা, তাদের প্রতিনিধি স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ও তার পাকিস্তানি দোসররা। গণহত্যার বিষয়টিকে তারা খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে। এর উদ্দেশ্য ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অবলেপন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হয়। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধ করা হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা হবে, সর্বোপরি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে নারকীয় ও বর্বরোচিত এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবহিত করে গণহত্যাকারী ও তার দোসরদের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি বাঙালি জাতি ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে নিহত সব শহীদসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদ ও সম্ভ্রমহারা ২ লক্ষ মা-বোনকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবে।

গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি

শুক্রবার (২৫ মার্চ) গণহত্যা দিবসে রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাকআউট’ পালন করা হবে। তবে কেপিআই এবং জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে। এ রাতে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবন ও স্থাপনাগুলোতে কোনও আলোকসজ্জা করা যাবে না। তবে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে।

গণহত্যা দিবস পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সকাল ১০ টায় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে। সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

এছাড়া স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।

দিনটি যথাযোগ্য মার্যাদায় পালনে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। দলটি শুক্রবার বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভা করবে। এতে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখবেন।

Share