আওয়ামী লীগ বিগত ১৭ বছর দেশের ক্ষমতা আকড়ে ছিলো। খুব সহজ ছিলো না এই ক্ষমতা আকড়ে থাকা। কারণ এই ১৭ বছর দেশের এতোগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে কেউ মন থেকে আওয়ামী লীগের সাথে ছিলো না। যারা সাথে ছিলো তারা হয়তো নীতি এবং রাজনীতি না বুঝে বাধ্য হয়ে সাথে থেকেছে না হয় লোভে পড়ে সুযোগ সুবিধা, ক্ষমতা এবং লুটপাটের ভাগ বুঝে নেওয়ার জন্য দেশ ও জাতির সাথে বেইমানি করেছেন। তাদেরকেও জাতি এতোদিনে চিনেফেলেছে। তাদের ধারণা ছিলো আওয়ামী লীগকে হটানোর মতো শক্তি আর কারো নেই। তাই দূরে থেকে লাভ কি? তাদের সাথে থেকে যা খেতে পারি খেয়ে নিই। এর মধ্যে জাতীয় পার্টি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং তরিকত ফেডারেশনসহ কিছু দল ও ব্যক্তির কথা আর কি বলবো। এখানে জাসদ-বাদস উল্লেখ না করে রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুর নাম উল্লেখ করার কারণ হলো তাঁরা সব সময় আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে থেকে সব ধরনের ক্ষমতা এবং সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে কিন্তু তাদের দল ছিলো ভিন্ন পথে। একেবারে প্রথম আলো পত্রিকার মতো গভীর জলের মাছের ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলো।
সে যাই হোক এখন আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে যা যা করা দরকার তার সবই করেছিলো তারা। কিন্তু শেষ অবদি আর রক্ষা হলো না হাসিনা সরকারের। আজানের ধ্বনীতে গৌরগোবিন্দের রাজ ফাসাদের মতো মূহুর্তেই যেন খান খান হয়ে গেলো আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মসনদ। একেই বলে বুঝি ‘নদীর একুল ভাঙ্গে ঐকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা, সকাল বেলার ধনীরে তুই ফকির সন্ধ্যা বেলা।’ ছাত্র আন্দোলন সেতো আবাবিল পাখির মতো ঘটনা। কি থেকে কি হয়ে গেলো বুঝে উঠা দায়। আসলে প্রকৃত সত্য হলো একটি দলের লোক বাদে পুরো জাতি এক হওয়ার শক্তি। সমগ্র জাতি এক হওয়ার শক্তি পারমানবিক বোমার চাইতেও আরো বেশি ভয়ানক। ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়াতো জাতির কাছে মামুলি ব্যাপার।
সে যাই হোক জনগণকে সন্তুষ্ট রেখে সকল দল ও মতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় থাকা আর জোর করে ক্ষমতা আকড়ে থাকা কখনই এক হতে পারে না। কোন চর দখল করে লুটপাট করে খাওয়া সম্ভব হতে পারে কিন্তু দেশ ও জাতিকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা আকড়ে থাকা বা দখল করে লুটপাট করে খাওয়া তার চাইতে অনেক বেশি কঠিন যে তা শেখ হাসিনার পরিনতিতে আর বুঝতে বাকি নেই কারো।
শেখ হাসিনা ক্ষমতা আর দেশ ফেলে পালিয়ে যে বার্তা দিয়ে গেছেন অন্যদলের জন্য তা কল্পনা করলেও গা শিউরে উঠার কথা। কিন্তু যারা ৫ আগস্টের পর অনেকটাই ক্ষমতার কাছাকাছি তাদের চালচলনে এবং কাজ কারবারে আমরা সেই পরিশুদ্ধতা বা শিক্ষা দেখতে পাচ্ছি?
আমরা মনে করি ৫ আগস্টের পর থেকে সকল রাজনৈতিক দল ও সব নাগরিককে রাজনীতির চিরচেনা আচার আচরণ, চালচলন, কাজ কারবার, চিন্তা চেতনা এবং পরিকল্পনার বিস্তর পরিবর্তন আনা দরকার হয়ে পড়েছে। কারণ আর কতবার ৫ আগস্ট সৃষ্টি হলে আমাদের পরিবর্তন হবে? তাহলে বুঝা যায় আমরা জাতিগতভাবে বিপ্লবি হলেও আমাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মনোভাব এখনো ব্রিটিশ, পাক ভারত এবং পাকিস্তানী রয়েগেছে। এমনকি জাতি হিসবেও আমাদের যথেষ্ট পরিবর্তন নেই। যেই মনোভাবের জন্য ব্রিটিশ ভেঙ্গে পাক ভারতের জন্ম হয়েছিলো এবং পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো সেই মনোভাব আমাদের দেশের রাজনীতির মধ্যে খুব পাকাপোক্তভাবেই বিরাজমান।
তবে কি আমাদের রাজনীতি এখনো ব্রিটিশ, ভারত ও পাকিস্তানী মনোভাবেই চলতে থাকবে? যদিও তা কস্মিনকালেও সম্ভব হবে না। কারণ বাঙ্গালী জাতি বার বার জেগে উঠতে জানে এবং বিপ্লবি হতে জানে। তবে এই জাতির ব্যর্থতাও রয়েছে। আর তা হলো এদেশের রাজনীতিকে এখনো পরিশুদ্ধ করতে পারেনি তারা। পারেনি নিজেদের মতো করে গড়ে তুলতে। এর জন্য এজাতি অনেকটাই দায়ি। কারণ আমরা এমন একটা জাতি যে জাতি খুব নিরবে জুলুম, নিপিড়ন, অত্যাচার ভোগ করে যায়। জুলুম, নিপিড়ন আর অত্যাচার ভোগ করতে করতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকবে ঠিক তখন চৈতন্য ফেরে এই জাতির। এর আগে তারা জাগে না। অন্যায় অত্যাচারের শুরুতেই রুখতে জানে না এজাতি। যদি রুখতে জানতো তাহলে ১৫ আগস্ট হতো না, ২৮ অক্টোবর হতো না এবং আরেকটি ৫ আগস্ট সৃষ্টি হতো না। আমরা খুব দুঃখ কষ্ট সহিষ্ণু জাতি। এটাই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট?
আসলে জাতি হিসেবে আমাদেরকে মুল ধারায় ফিরতে হবে। স্বচেতন জাতি হিসেবে আমাদেরকে ন্যায় অন্যায় ও অপরাধ অপরাধি শুরুতেই চিনতে হবে এবং অপরাধিকে শুরুতেই রুখে দিতে হবে। সেকেলে মনোভাবের জাতি হিসেবে আর কতোকাল বাঁচবো? এবার রাজনীতিকে সাইজ করার সময় এসেছে। এই সময়কে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। যাতে কোন রাজনৈতিক দল আমাদেরকে আমাদের ইমোশন, আমাদের ভালো মানসিকতা, আমাদের উদারতা, আমাদের কষ্ট সহিষ্ণুতা নিয়ে আর খেলতে না পারে সেই জন্য আমাদের এবার জাগ্রত হতে হবে। কেউ নিজে ভালো না হয়ে আমাদেরকে কেউ যেন ভালো হওয়ার জ্ঞান দিতে না পারে এই বিষয়ে খুব সচেতন হতে হবে। পার্টির দোহাই দিয়ে অন্যায় অপরাধ করে যাবে আর আমি সাপোর্টার হয়ে সব হজম করে যাবো এমনটা আর হতে দেবো না। আমাদের সামনে যেন আর কোন ৫ আগস্ট না আসে আমারা এখনই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবো। কারণ ৫ আগস্ট রাজনৈতিক দলের কিছু না সকল দায় এবং দায়িত্ব জাতির উপরই পড়বে। ৫ আগস্টের রক্তের উপর ভর করে কোন রাজনৈতিক দল গঠিত হোক তাও আমরা চাই না। কারণ ৭১ এর রক্তের উপর ভর করে রাজনীতি করে সেই জাতিকে দলন নিপিড়নেই ব্যবস্ত হয়ে পড়ে। তাই আমরা আর কোন রক্তের উপর ভর করে কাউকে সুবিধা অর্জনের সুযোগ করে দিয়ে আরেকটি সৈরাচার সৃষ্টি হতে দিবো না। আর না হয় আমাদের এই ৫ আগস্টেও জাতিকে বিভক্ত করা হবে। জাতিকে রাজাকার আলবদর বানিয়ে বিভাজন করে জুলুমবাজের নয়া উত্থান হবে। আমরা আর এমনটা চাই না। আমরা মনেকরি ৫ আগস্টকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কোন দল যাতে ৫ আগস্টের ফায়দা লুটতে না পারে সেই জন্য এই জাতিকে এখনই স্বচেতন হতে হবে এবং সদা জাগ্রত থাকতে হবে। এখন থেকে বাংলার মসনদে কেউ বসতে হলে সর্বোচ্চ নীতি তৈনিতা এবং ভালো মানুষের পরিচয় দিতে হবে। ক্ষমতায় গিয়ে ভালো হবে সেই আশ্বাস আর আমরা বিশ্বাস করি না। এখন কে কি করছেন সেটার উপরই নির্ভর করবে আগামীর ক্ষমতার ভবিষ্যত। কে কত বড়ো তা ডান্ডায় নয় মানসিকতায় প্রমাণ হবে। কারণ আর যাতে কোন জুলুমবাজ এবং ক্ষমতার দখলবাজ সৃষ্টি হতে না পারে এই বাংলার জমিনে। তাই আমাদেরকে শুরু থেকেই ভাবতে হবে আমাদেরকে কে শাসন করবে। কে বড়ো দল আর কে ছোট দল সেটা ৫ আগস্টের পর আর বিবেচ্য হওয়ার কথা নয়। কারণ জাতি সেই দেয়াল ভেঙ্গে দিয়েছে। রাজনীতির বাইরে থেকে যে মানুষগুলো বিল্পব এনে দেয় সেটার কাছে কোন বড়ো দলই বড়ো নয়। জাতির কাছে সেটা অনেক অনেক ছোট এবং তুচ্ছ। কিন্তু জাতির লাফখাফ ছোট বলেই রাজনৈতিক দলের হম্বিতম্বি অনেক বড়ো মনে হয়। কারণ জাতি হিসেবে সাধারণ মানুষ শান্তি চায় আশান্তি চায় না। তাই জাতি সব সময় চুপচাপ। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোই বার বার বোকা বনে যায় জাতির কাছে। জাতি ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দলগুলোকে ভয়ে হোক আর ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক গাছের আগায় উঠতে দেয়। আর ক্ষমতাবাজ রাজনৈতিক দল ক্ষমতা পেয়ে গাছের আগায় উঠে গোড়ায় থাকা জাতিকে আর পাত্তাই দেনা। বরং জাতির আর্তনাদ আর আহাজারি শুনে বিরক্ত হয়ে আরো মগডালে উঠে বসে সুখের নিদ্রা যায়। যাতে মানুষের কান্না আর আহাজাতির শব্দ তাদের কাছে না পৌঁছে। যার কারণে আর সইতে না পেরে জাতি ক্ষমতার গোড়ায় কুঠার আঘাত করতে বাধ্য হয়। তখন মগডালে থাকা বিশাল ক্ষমতাধর শক্তি একসময় ধপাস করে মাটিতে আচড়ে পড়ে অথনা ছিটকে দিল্লি গিয়ে পড়ে।
তাই আমি আজকের লেখায় আমাদের রাজনৈতিক কোন দলকে জ্ঞান দেবো না বরং ৫ আগস্ট সৃষ্টিকারী এ জাতিকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করবো। আমাদেরকে বার বার ৫ আগস্ট সৃষ্টি করে ঘুমিয়ে গেলে চলবে না আমাদেরকে ৫ আগস্টের মনোভাব আগামির প্রতিক্ষণ, প্রতিদিন এবং প্রতিটা মুহুর্ত লালন করতে হবে। আমরা জাতি হিসেবে বিশাল শক্তিশালি। কোন দল বা গোস্টি আমাদের কাছে খাওন নাই। আমরা চাইলেই উপড়ে ফেলতে পারি যে কোন শক্তিকে। আমরা ক্ষমতায় যাই না কিন্তু আমরাই ক্ষমতায় পাঠাই। প্রয়োজনে ৫ আগস্ট সৃষ্টি করি। তাই জিনিই ক্ষমতায় যাবেন তিনি যেন ৫ আগস্ট সৃষ্টিকারীদের সামনে মাথা নত করে থাকেন। আমাদেরকে সব সময়ই রাজনীতির পেছনে বড়ো হেমার নিয়ে তাড়িয়ে বেড়াতে হবে। এই ভূমিকা থেকে আমাদেরকে অবসর নিলে চলবে না। আমরা আর ৫ আগস্ট সৃষ্টি করতে চাই না। এই চাওয়ার বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে সব সময়, সময়ে অসময়ে এবং ভোটে-নির্বাচনে সব সময় ভূমিকা রাখতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার আগে অমাদের নিজেকে এভাবেই স্মার্ট হতে হবে। তবেই টিকবে বাংলাদেশ এবং গড়ে উঠবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
লেখক, প্রধান সম্পাদক দৈনিক চাঁদপুর সময়।