স্বাদে গন্ধে বাংলাদেশের ইলিশ অতুলনীয়। বাঙালির ঐতিহ্য ও গৌরবের এক অনন্য প্রতীক আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। এদেশের ইলিশের সুনাম পৃথিবীর সর্বত্র। অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু এ মাছ যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং নিরাপদ আমিষ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
একক মাছের প্রজাতি হিসেবে দেশের মৎস্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে ইলিশ। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১২.২২% আসে ইলিশ থেকে।
২০১৯-২০ সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫.৫০ লাখ মেট্রিক টন, যার বাজার মূল্য প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। নির্বিচারে জাটকা নিধন, অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা মা ইলিশ আহরণ, কারেন্ট ও বেহুন্দি জালের অবাধ ব্যবহার , ঊজানে নদীর পানির প্রবাহ হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সর্বোপরি পরিবেশ দূষণের কারণে ২০০২-০৩ সালের দিকে ইলিশের উৎপাদন আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছিলো।
কিন্ত আশার কথা হল বিগত কয়েক বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নানা উদ্যোগের ফলে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। তবে, ইলিশ বৃদ্ধির এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষার করতে হবে।
১০ ইঞ্চি বা ২৫ সেন্টিমিটারের (ঠোঁট থেকে লেজের প্রান্ত পর্যন্ত) কম দৈর্ঘ্যের ইলিশকে জাটকা বলা হয়। আজকের জাটকা আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা ধরা হলে পরিপক্কতা লাভের সুযোগ বিঘ্নিত হয়ে বড় ইলিশ পাওয়া যায় না ফলে পরবর্তীতে মা ইলিশ থাকেনা। বিধায় বংশবৃদ্ধির সুযোগ থাকেনা।
প্রাকৃতিকভাবে মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার পর তা থেকে পোনা এবং বড় হয়ে জাটকা এবং পরবর্তীতে বড় ইলিশে পরিণত হয়। একটি মা ইলিশ ২.৫ লক্ষ থেকে শুরু করে ২৩ লক্ষ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে অর্থাৎ একটি মা ইলিশ ধরলে ২৩ লক্ষ পোনা উৎপাদন বন্ধ হয়। জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ ধরার কারণে ইলিশের উৎপাদন কমে যায়, ফলে জেলেদের উপার্জনও কমে যায়। তাই ইলিশের ভবিষ্যৎ উৎপাদন এবং জেলেদের উপার্জন বৃদ্ধির জন্যই জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়ে থাকে। অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা, প্রতিবছর ৮ মাস জাটকা ও প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন, সমুদ্রে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা, বিশেষ কম্বিং অপারেশনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে।
দেশে পদ্মা-মেঘনা অববাহিকায় ইলিশের মোট অভয়াশ্রম রয়েছে ছয়টি (পাঁচটিতে মার্চ-এপ্রিল মাছ ধরা বন্ধ, আন্ধারমানিক ব্যতীত), যার মোট আয়তন ৪৩২ কিলোমিটার।
উল্লেখ্য, পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীর অভয়াশ্রমে মাছধরা নিষিদ্ধকালীন সময় নভেম্বর-জানুয়ারি। এ ছয়টি অভয়াশ্রম বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, লক্ষীপুর, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর জেলাজুড়ে বিস্তৃত। ইলিশের এসব অভয়াশ্রম ছাড়াও সব নদ-নদীতে মার্চ-এপ্রিল মাসে এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। এ সময় সারাদেশে জাটকা আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।
পাশাপাশি, ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে প্রতিবছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৮ মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ থাকে। চান্দ্রমাসের ভিত্তিতে প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরে প্রতিবছর আশ্বিন মাসে প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার ৪ দিন আগে থেকে পূর্ণিমার দিনসহ পরের ১৭ দিন মিলিয়ে মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা, মজুদ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিক্রি নিষিদ্ধ থাকে।
সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও সংরক্ষণে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সব ধরনের মাছ ও চিংড়ি আহরণ নিষিদ্ধ থাকে। জাটকা যেন ইলিশ ধরার জালে আটকে না যায়, তাই সরকার ইলিশ ধরার ফাঁস জালের সাইজ ৬ দশমিক ৫ সেমি নির্ধারণ করেছে।
ইলিশ রক্ষায় প্রতি বছর জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ পালন করে সরকার। সাধারণত মার্চ বা এপ্রিল মাসে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। মৎস্য সম্পদ ধ্বংসকারী কারেন্ট জাল, বেহুন্দি ও অন্যান্য অবৈধ জাল নির্মূলে প্রতিবছর বিশেষ কম্বিং অপারেশন পরিচালিত হয়।
সরকারের গৃহীত মৎস্য সম্পদের সংরক্ষণ ও সফল ব্যবস্থাপনার জন্য মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শুধু আইন প্রয়োগে এর সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়।
ইলিশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার প্রাথমিক সফলতার সূত্র ধরে সরকারের নানাবিধ উদ্যোগ এর পাশাপাশি মৎস্য অধিদপ্তর এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট (ইউএসএআইডি) অর্থায়নে পরিচালিত ইকোফিশ প্রকল্প ২০১৪ সাল থেকে মেঘনা নদীর বাস্তুতন্ত্র এবং এর উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য ইলিশ অভয়ারণ্যগুলিতে বিজ্ঞান-ভিত্তিক অভিযোজিত সহ-ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেছে।
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রচেষ্টায় মৎস্য সম্পদের এর সংরক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনাকেই সহ-ব্যবস্থাপনা বলে। সহ-ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে পদ্মা, মেঘনার ঊর্ধ্বাঞ্চল ও নিম্ন অববাহিকায়, কালাবদর, আন্ধারমানিক ও তেঁতুলিয়াসহ অন্যান্য উপক‚লীয় নদীতে অংশীদারত্বমূলক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে।
সহ-ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম এর প্রাপ্ত ফলাফলগুলি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসহ অন্যান্য অংশীজনদের সক্ষমতা বাড়াতে এবং দেশব্যাপী এ সংক্রান্ত যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কিং কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়েছিল।
এ কার্যক্রমের আওতায় মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরা কমানো, সঠিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা এবং জীবিকার বৈচিত্র্যে মৎস্যজীবীদের সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ের উপর বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে।
এ সকল সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে ২০১৬ সাল থেকে মোট ইলিশ উৎপাদন শতকরা ৫ থেকে ১১ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। যা ২০২০ সালে ৫.৫ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়। পাশাপাশি, মাছের প্রাচুর্যতা এবং আকার উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।
সহ-ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর কার্যকর অংশগ্রহণে গঠিত হয়েছে কমিউনিটি ফিশ গার্ড যাতে যুক্ত হয়েছেন ইলিশ মাছ ধরার কাজে যুক্ত জেলে পরিবার। এক সময় ইলিশ মাছধরা ছিল যাদের পেশা, এবার তারাই জোরেশোরে মাঠে নেমেছিল সেসব মাছের সুরক্ষায়। অভয়াশ্রমগুলোতে ইলিশ রক্ষায় সরকারি সংস্থাগুলোর সহায়তাকারী হিসাবে দিনরাত পাহারা দিচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশের উপকূলবর্তী ইলিশসমৃদ্ধ জেলা ভোলা, বরিশাল পটুয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষীপুর, শরীয়তপুরের ১৫ উপজেলার ৩৩০ জন ইলিশ ধরা জেলেদের বাছাই করে কমিউনিটি ফিশ গার্ড হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও ইলিশ সম্পদের উন্নয়নে জাটকা সংরক্ষণের জন্য দেশের পাঁচ জেলার ৬ টি ইলিশ অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় বরিশাল জেলার হিজলা- মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার মেঘনা-কালাবদর-গজারিয়া নদী, চাঁদপুর, লক্ষীপুর ও ভোলা জেলার মেঘনা নদী, তেঁতুলিয়া নদী ও শরীয়তপুর জেলার পদ্মা নদীর ইলিশ অভয়াশ্রম সংশ্লিষ্ট নদ-নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছধরা বন্ধ থাকার ঘোষণা বলবৎ আছে।
এ সময়ে ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় মৎস্য অধিদপ্তরের সহায়তাকারী হিসাবে কমিউনিটি ফিশগার্ডদের যুক্ত করতে সংশ্লিষ্ট মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের আওতায় ‘ইলিশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ তহবিল থেকে সকল ফিশ গার্ডদের প্রণোদনা বা সম্মানী ভাতা দিতে বলা হয়েছে।
গার্ডের সদস্যরা নিষেধাজ্ঞাকালে নির্ধারিত এলাকায় পাহারা দেওয়া, মৎস্য বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর কাজে সহায়তাসহ তথ্য দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন।
ইউএসএ আইডির অর্থায়নে পরিচালিত মৎস্য অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ অ্যাক্টিভিটির আওতায় গঠিত কমিউনিটি ফিশগার্ড সদস্যরা ইলিশ ও মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ২০১৬ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।
কমিউনিটি ফিশগার্ড সদস্যদের সহব্যবস্থাপনা কার্যক্রম, জাটকা ও মা ইলিশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, ইলিশের অভয়াশ্রম, ইলিশ সংরক্ষণ নীতিমালা ও মৎস্য আইন, ইলিশ অভয়াশ্রম পাহারা কার্যক্রমের গুরুত্ব, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পাহারা কার্যক্রম বাস্তবায়ন, মৎস্য বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা এবং তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার জন্য পরিচয়পত্র, ট্রাউজার, গামছা, ছাতা, অ্যাপ্রোন, জুতা, টর্চলাইট প্রদান করা হয়েছে।
জাটকা সংরক্ষণ প্রকল্প/কর্মসূচির মাধ্যমে চলমান ইলিশ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার জন্য সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে যেমন বিকল্প আয়ের কার্যক্রমে ইলিশ জেলেদের জড়িত করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ এবং জাটকা ধরা নিষিদ্ধ সময়ে উপকুলীয় এলাকার জেলেদের জীবন ধারণের জন্য ভিজিএফের (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) আওতায় খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়।
বিকল্প আয় সৃষ্টি কার্যক্রমের মাধ্যমে ইলিশের অভয়ারণ্য এলাকার মোট ২২ হাজার জেলে পরিবার বা তাদের ১ লাখ ২০ হাজার সদস্য সরাসরি উপকৃত হচ্ছে।
সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের সফল ব্যবস্থাপনার জন্য সহ-ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বাস্তবায়িত করতে হলে এতে সকল অংশীদারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জেলেদের অংশগ্রহণে গঠিত কমিউনিটি ফিশ গার্ড কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। ফিশ গার্ডদের প্রণোদনা বা সম্মানী সময়মত প্রদান করা দরকার।
পাশাপাশি, জেলেদের জীবিকা নির্বাহের এবং বিকল্প উপার্জনের জন্য তাদের প্রয়োজন ভিত্তিক সহায়তা প্রদান জরুরী। সহ-ব্যবস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জেলেদের পরিবারের নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
ইলিশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিলের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সুপরিকল্পিতভাবে ডাটা সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, বিভিন্ন প্রতিবেদনে তা যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে।
লেখক: মৎস্য বিজ্ঞানী, ইউএসএআইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশের ইকোফিশ-২ অ্যাক্টিভিটি