পবিত্র কোরআনে অসংখ্য স্থানে নামাজের সঙ্গে সঙ্গে জাকাতের কথা উল্লেখ আছে। আল্লাহতায়ালা নামাজ আদায় করাকে এবং জাকাত প্রধান করাকে একজন মানুষের খাঁটি মুসলমান হওয়ার আলামত এবং আল্লাহতায়ালার বিধানাবলির প্রতি আনুগত্য ও মুসলমানের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নিদর্শন সাব্যস্ত করেছেন।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এরপর যদি তারা (কাফেররা) তওবা করে, নামাজ আদায় করতে শুরু করে এবং জাকাত দিতে শুরু করে, তাহলে তারা তোমাদের দ্বীনী ভাই হয়ে যাবে। আমি বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের জন্য বিধানসমূহকে খুলে বয়ান করে থাকি। (সুরা তাওবা, আয়াত ১১)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যাকে আল্লাহতায়ালা সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর জাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেঁটো-মাথাবিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পাশে কামড়ে ধরে বলবে আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল।’ (বুখারি শরিফ ১৩২১)। জাকাতের মাধ্যমে একটি কল্যাণকর ও ইনসাফভিত্তিক সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থার অস্তিত্ব লাভ করে এবং এটি সমাজের স্বনির্ভরতা অর্জন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক প্রয়োজন পূরণ এবং সমাজের প্রত্যেক সদস্যের জন্য সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ সৃষ্টির একটি কার্যকর ব্যবস্থা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতাআলা তাদের ওপর জাকাত অপরিহার্যরূপে নির্ধারণ করেছেন, যা তাদের সম্পদশালীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ (মুসলিম শরিফ ১৯)।
জাকাত প্রদান অনুগ্রহ নয় বরং সৌভাগ্য মুমিনের অবস্থা হল, সে জাকাত আদায় করতে পেরেছে এবং দরিদ্র মানুষরা তার জাকাত গ্রহণ করেছে; এজন্য সে আল্লাহতায়ালার শুকরিয়া আদায় করে। আর সে মনে মনে বলেন: হে আল্লাহ, আমি আপনার মহান একটি হুকুম আপনার বাতলানো ও নির্দেশিত স্থানে আদায় করতে পেরেছি। শুধু শুকরিয়া আদায় নয়; বরং মুমিন বান্দা জাকাত আদায়ের পরে আনন্দ বোধ করে। পাশাপাশি দরিদ্র মানুষগুলোর প্রতিও কৃতজ্ঞ হয় যে, তারা তাকে এ ফরজটি আদায় করার এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করার সুযোগ দিয়েছে। জাকাত দেওয়াকে কারও প্রতি অনুগ্রহ বিবেচনা করার চিন্তাও মুমিনের মনে আসে না। কেননা জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে কারও প্রতি অনুগ্রহ করা হয় না। হকদারকে তার হক পৌঁছে দেওয়া হয়েছে মাত্র। আল্লাহতায়ালা তাঁর সম্পদে আমাদের প্রতিনিধি বানিয়েছেন। সুতরাং সম্পদ তাঁর হুকুম মতোই খরচ করতে হবে।
এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আন এবং তিনি তোমাদের যার উত্তরাধিকারী করেছেন, তা থেকে ব্যয় করো। অতএব, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।’ (সুরা হাদিদ, আয়াত ৭)। মুমিন বান্দার এই বিশ্বাস থাকে যে, জাকাত ও অন্যান্য সদ্কা-খয়রাত যদি ইখলাসের সঙ্গে হয় এবং হালাল মাল থেকে হয়, তাহলে এর বিনিময়ে আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে। আর আখেরাতের খাজানাতে জমা করে আল্লাহ এর একেকটি দানাকে ওহুদ পাহাড়ের মতো বিশাল সম্পদে পরিণত করবেন।
অনেকে জাকাতকে ট্যাক্স মনে করেন। এটা মূর্খতার আলামত। জাকাত বোঝা ও ট্যাক্স নয়; বরং জাকাত হলো ইবাদত। ট্যাক্স ন্যায্য হোক বা অন্যায্য হোক, এর সঙ্গে জাকাতের হাকিকত, উদ্দেশ্য, উপকারিতা এবং খাত কোনো দিক দিয়েই জাকাতের কোনো মিল নেই। জাকাতের যে বাস্তবিক উদ্দেশ্য, তা ট্যাক্সের মধ্যে পাওয়া যায় না। জাকাতের খাত হলো ফকির, মিসকিন, ইবনে সাবিল প্রভৃতি। পক্ষান্তরে ট্যাক্সের সুবিধা ভোগ করে সম্পদশালী ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ। জাকাত অন্তরের পরিশুদ্ধি ও সম্পদের পবিত্রতার জন্য সৃষ্টিকর্তার হুকুমে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আদায় করা হয়। এ বিষয়টি ট্যাক্সের মধ্যে পাওয়া যায় না।
জাকাতের গুরুত্ব ও ফজিলত জাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি অন্যতম স্তম্ভ। মহান আল্লাহতায়ালা ধন-সম্পদের সঙ্গে যে বিধিবিধান রেখেছেন, তম্মধ্যে জাকাত সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। ঈমানের পর দৈহিক ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ, ঠিক তেমনিভাবে আর্থিক ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাকাত। সীমাহীন গুরুত্বের কারণে এ দুটো ইবাদতের আলোচনা বা কথা আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে পাশাপাশিই রেখেছেন। ইসলামে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদে ৮২ স্থানে নামাজের সঙ্গে সঙ্গে জাকাতের কথাও উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দৈহিক ইবাদত হিসেবে নামাজ যেমন অতীব জরুরি, তদ্রৃপ আর্থিক ইবাদত হিসেবে জাকাতও অতীব জরুরি। এছাড়া নামাজ ও জাকাত একটি অপরটির সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।