ন্যায়ের পক্ষে,গণমানুষের হয়ে শাসকের বিরুদ্ধে সর্বদা শির উঁচু করে কথা বলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শিল্পকে মাধ্যম করে লড়াই জারি রাখার তালিকা আরো সংক্ষিপ্ত। দৃশ্যমাধ্যমকে পুঁজি করে বাংলাদেশের জনতার মুক্তির আন্দোলনের কথা তীব্রভাবে বলে যাওয়া মানুষটি জহির রায়হান। একাধারে সাহিত্যিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংবাদিক, প্রযোজক এ ব্যক্তি বাংলাদেশী মানুষের কাছে এক অমর নাম।
মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ জহির রায়হান নামে সর্বজন সমাদৃত। জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনীতে। বাবার চাকরির সুবাদে কলকাতায় বসবাস করলেও ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পুরো পরিবার ফিরে আসে বাংলাদেশে। ছাত্রাবস্থায়ই গণমানুষের স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করতে যুক্ত হয়েছিলেন বামধারার রাজনীতিতে। সেই থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিরুদ্দেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত জহির রায়হান লড়ে গেছেন মানুষের হয়ে।
চলচ্চিত্র, সে তো মনের কথা বলে। যাপিত জীবনকে দৃশ্যমাধ্যমে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলে শুধু অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেই নয়, বরং এর মধ্যে নিহিত জীবনসংগ্রাম, সমাজ সংস্কার, মুক্তির আন্দোলনই যেন জহির রায়হানের চলচ্চিত্রের মূল ভাষ্য। জহির রায়হান বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যেও অন্যতম। তার নির্মিত চলচ্চিত্র কথা বলেছে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন নিয়ে, কাজ করেছে মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা হিসেবে। সব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গণমানুষের হয়ে বিজয় নিশান উড়িয়েছেন তিনি।
রাষ্ট্র-সমাজকে সংস্কার করবার প্রয়াস থেকে, নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শের জায়গা থেকে ক্ষণজন্মা জীবনে জহির রায়হান নির্মাণ করেছেন ১০টির বেশি চলচ্চিত্র, যার প্রতিটিই সমাদৃত।
১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্র দিয়ে নির্মাতা হিসেবে তার যাত্রা শুরু। অর্জনের ঝুলিতে আছে আরো অনেক কিছু। ১৯৬৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র ‘সংগম’ নির্মাণ করেছেন তিনি, যা ছিল উর্দু ভাষায়। বাংলাদেশে প্রথম ইংরেজি ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এর প্রযোজক তিনি।
জহির রায়হান নির্মিত অন্যতম চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯-এর তীব্র গণ-আন্দোলন, মিছিল-মিটিং, শহীদ দিবস উদযাপন, স্লোগান, নজরুলের শেকল ভাঙার গান ইত্যাদি পটভূমিতে নির্মিত এ চলচ্চিত্র মানুষের মুক্তির জয়গান গেয়েছে। মূলত প্রতীকীধর্মী ও রূপক অর্থে নির্মিত জীবন থেকে নেয়া চলচ্চিত্র বাংলাদেশে নির্মিত প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। একটি দেশ, একটি সংসার, একটি চাবির গোছা থেকে একটি আন্দোলন বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে, অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কীভাবে রূপ নিয়েছে তা সুনিপুণ হাতে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন গানের সুরে, গেয়েছেন ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে?’ তাই তো আজও জহির রায়হান সমাদৃত তার দৃঢ় সংকল্প, সাহসী নির্মাণের জন্য।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত অর্জনে অবিরাম কাজ করে গেছেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার প্রমাণস্বরূপ প্রামাণ্যচিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ আজও কাজ করছে মুক্তি আন্দোলনে মানুষের ত্যাগের দলিল হিসেবে। সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ না নিলেও মুক্তিযুদ্ধের সত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার প্রয়াস থেকে ক্যামেরা হাতেই যুদ্ধ করেছেন। সত্যকে উন্মুক্ত করতে তার ক্যামেরা হয়েছে রাইফেল আর চলচ্চিত্র রূপ নিয়েছে গ্রেনেডে। তার সে যুদ্ধের মধ্য দিয়েই বিশ্ব জেনেছে পাকিস্তানি দোসরদের নৃশংসতার কথা।
ঔপন্যাসিক হিসেবেও তার অবস্থান অন্য অনেকের চেয়ে কয়েক সিঁড়ি ওপরে। জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। তার কালজয়ী উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’। গ্রাম বাংলার প্রেক্ষাপটে নির্মিত হাজার বছর ধরে চলমান বাঙালি সংস্কৃতির সূক্ষ্ম অথচ তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন তিনি। আশা-নিরাশা, প্রেম-বিরহ, ঘাস-ফুল-পাখির জীবনে নদীর মতো বয়ে যাওয়া হাজার বছর ধরে ঘটে চলা অন্যায়, নির্যাতনের এক দুর্দান্ত রূপরেখা এ উপন্যাস।
যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে বহুল প্রচলিত লাইন ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের এ লাইন তরুণ প্রজন্মকে শুধু উদ্বুদ্ধই করে না বরং রক্তকেও আন্দোলিত করে।
জহির রায়হানের লেখনী, নির্মাণকলার মূলেই ছিল গণমানুষ। মানুষের জীবন ও জীবিকা, বেঁচে থাকার প্রয়াস এবং সে প্রয়াসের মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তিই ছিল জহির রায়হানের অনুসন্ধিৎসা। পরিবারকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র, উপন্যাস, গ্রামীণ জীবনাচার, শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা কিশোরীর প্রেম-পরিণয় ও জীবনযুদ্ধ সবক’টিতেই ঢুঁ মেরেছেন জহির রায়হান। বলা চলে, জীবনের দোলাচলের সবটাই পরখ করতে চেয়েছেন আপন হাতে এবং সবাইকে তা বলতে চেয়েছেন বলিষ্ঠ কণ্ঠে।
চাঁদপুর টাইমস
১৯ আগস্ট ২০২৪
এজি