জলবায়ু পরিবর্তনে দুর্যোগ ঝুঁকিতে রয়েছে চাঁদপুরসহ বাংলাদেশের সকল উপকূলীয় অঞ্চল। আর এর প্রভাবে দেশের ৪০ ভাগ মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
চাঁদপুরসহ দেশের গোটা উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কয়েক দশকে দেশে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে ঘন ঘন বন্যার প্রবণতা বেড়েছে। ক্রমেই বেড়ে চলেছে বন্যার ভয়াবহতা। লবণাক্ততা, নদীভাঙনসহ বহুমুখী দুর্যোগের কবলে পড়ছে উপকূলের মানুষ।
২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু-সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে দাবদাহের পরিমাণ বেড়ে যাবে সেই সঙ্গে মৌসুমি বৃষ্টিপাত কমে আসবে। আবার কখনো কখনো অল্প সময়ে অধিক বৃষ্টি হবে।
অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষ উচ্চ দুর্যোগ-ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা এক কোটি ৩৫ লাখে বৃদ্ধি পেতে পারে।
চাঁদপুর, বরিশাল, বাগেরহাট, বরগুনা, ভোলা, , চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, গোপালগঞ্জ, যশোর, ঝালকাঠি, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, শরীয়তপুর।
আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই সব অঞ্চলের মানুষ। কেউ পড়ছে নদী ভাঙনের কবলে আবার কেউ হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সর্বশান্ত
এর প্রভাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, মৎস্যজীবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় বেড়েছে নানা ধরনের দুর্যোগ। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো খাদ্য নিরাপত্তাহীতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে অস্বাভাবিক জোয়ারের চাপে ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে উপকূলের নদ-নদীও। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে পানির উচ্চতা। যেমন বেড়েছে জোয়ারের তীব্রতা তেমনি বেড়েছে খরার তীব্রতা। খরা ও তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চল। আর অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহে এ অঞ্চলের কৃষি, অর্থনীতি ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়েছে।
চর জেলে পল্লীর সালাম মাঝাই বলেন, “এহন আর কোনো কিছুই ঠিক নাই, যহন বৃষ্টি হওয়ার কতা তহন হয় না, আবার যহন না হওয়ার কথা তহন হয় বেশি। একটু জোয়ার হলেই পানি সোজা ঘরের মধ্যে। বইন্যা বাদল হইলে তো কতাই নাই।”
সদর উপজেলার বৃদ্ধ (৬০) মোস্তফা বলেন, “আগে ঋতু আছেলে ছয়ডা এহন দেহি চাইড্ডা কি যে হইতে আছে কিছু বুঝিনা, রোজ কেয়ামত বুজি আইসা গেছে।”
কৃষক রহিম মোল্লা বলেন, তিনি প্রায় ৬০ শতক জমিতে এবার বোরো ধান আবাদ করেন। ধান পুষ্ট হওয়ার সময় তীব্র খরার সৃষ্টি হয়। এতে বেশির ভাগ ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে উপকূলীয় মানুষের জীবন যাত্রা নিয়ে কাজ করছে উন্নয়ন সংগঠন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অফ কোস্টাল এরিয়াস পিপলস (ডোক্যাপ)।
সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী মাসুদ আলম বলেন, “বিগত দিনগুলোতে আবহাওয়ার এমন অবস্থা দেখেনি এখানকার মানুষ। প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর আচরণের মধ্যে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবহাওয়ার এ ভয়াবহতা রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। না হলে উপকূলীয় মানুষের জীবন যাত্রা সংকটের মুখে পড়বে।”
বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, আগে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব ছিলো না। আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে এখন এ সম্পদ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের উপকূলীয় মানুষের জীবন যাত্রায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে চাইলে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন আ ক ম মোস্তফা জামান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলের অবস্থান ভয়াবহ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ফসলহানি, মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, “জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলসহ বাংলাদেশের ৩০ ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। এর মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে সুন্দরবন, সাতক্ষীরা, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, সন্দীপ ও চট্টগ্রামের কিছু অংশ। আর এ ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচতে হলে উন্নত বিশ্বগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “দেশের ৪০ ভাগ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঘন ঘন নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থা মোকাবিলায় দক্ষিণাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।”
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত মোকাবেলার কাজে দেশের দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিৎ বলেও তিনি মনে করেন।
(নদী ভাঙনের একটি ভয়বহ ভিডিওচিত্র)
|| আপডেট: ১২:৫৪ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০১৫, মঙ্গলবার
ডিএইচ/২০১৫।