মতলব উত্তর

জমে উঠেছে মতলব বেলতলীর লেংটা পাগলের মেলা

জমে উঠেছে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের বদরপুরের বেলতলীতে সপ্তাহ ব্যাপী শাহ্ সোলেমান লেংটা পাগলের মেলা। তবে ৭ দিনের এ মেলা আগে-পরে এক মাস স্থায়ী থাকে। সকালে এ মেলা উদ্বোধন করা হয়েছে।

মিলাদের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়। মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার পরই বিকেলে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পরিদর্শনে আসেন।

পরিদর্শনকালে বলেন- মাজারের পবিত্রতা রক্ষা করে সবাইকে চলতে হবে। মাজার এলাকায় কোন প্রকার মাদক বিক্রি ও সেবন করা যাবে না। ওরশে আসা দর্শনার্থীরা নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারে সেই দিকে নজর রাখতে হবে। রাস্তা-লঞ্চঘাটসহ কোথাও চাঁদাবাজি করা যাবে না।

দর্শনার্থীদের নির্ভিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়া এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি মানুষের দায়িত্ব। ওরশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ প্রশশাসন তৎপর রয়েছে। মেলা প্রাঙ্গন সিসি ক্যামরার মাধ্যমে ও পুলিশি নজরদারীতে রয়েছে।

সোলেমান লেংটা উপমহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়ার দাবিদার। বাংলা ১২৩০ সালে কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার গোবিনাদপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে শাহ্ সূফী সোলেমান লেংটা জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আলা বঙ্গ ভূঁইয়া। জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। সোলেমান লেংটা কখনও পোশাক পরিধান করতেন না। তাই তার মাজারটি লেংটার মাজার হিসেবেই পরিচিত। লেংটা ১৮ ফকির বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। সোলেমান শাহ নারায়ণগঞ্জের বকতগুলির রাধানগরে এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

এ দিকে মেলাকে ঘিরে হাজার হাজার ভক্তের পদচারনায় মুখরিত হয়েছে গোটা বেলতলীসহ আশেপাশের এলাকা। তিল ধারনের ঠাই নেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লঞ্চ, ট্রলার, বাস, মিনি বাস, ট্রাক, মেক্সী, সিএনজি, ট্রাক,প্রাইভেটকার যোগে ওরশে আসতে শুরু করেছে হাজার হাজার ভক্ত ও আশেকানসহ বিভিন্ন লোকজন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক রাখতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে এখ নপর্যন্ত কোথাও কোনো অপ্রতিকর ঘটনা ঘটিনি। লেংটা বাবার ৯৮ তম র্ওস উপলক্ষে আসতে শুরু করেছে তাঁরা নিয়ে আসেন গরু, মহিষ, ছাগল, মোরগ, ডিম, ডাল, চাউল, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন মানতি জিনিসপত্র। ল্যাংটা পাগলের মেলায় এসে সোলেমান শাহ ল্যাংটার অনুকরণ করছে তার ভক্তরা। আজ লেংটা বাবার ওরএসর চতুর্থ দিন। আগামী বৃহস্পতিবার এর সমাপ্তি হবে। আর এই মেলাকে ঘিরে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পকেটমার, ছিনতাই, মলমপার্টি, হিজরা, প্রতারকদের তৎপরতা দেখা গেছে।

শুরু হওয়া ল্যাংটা পাগলের মেলার প্রথম দু’দিনে দিনে যেন গাঁজার স্বর্গরাজ্যে (অভয়াশ্রমে) পরিণত হয়েছে। শুরু হয়ে গেছে গাঁজা খাওয়া ও বেচাকেনার ধুম। ঘুরতে গিয়ে অনুসন্ধানী চোখে তাকালেই দেখা যায়, দলে দলে ভাগ হয়ে গাঁজা টানছে পাগলের ক্ষুদ ক্ষদ্র্র দল। মনে এ যেন এক গাঁজার দেশে এলাম। ছোট ছোট তাবু তৈরি করে পুটলি করে কিশোর,যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত সবাই এসব গাঁজার আসরে মিলিত হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসন নিরব ভুমিকা পালন করে।

গতকাল মতলব উত্তর উপজেলা চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ মঞ্জু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম, মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আলমগীর হোসেন মজুমদার, প্রতিদিনাই মেলা পরিদর্শন করেছেন। এদিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকো লেংটার মেলায় আসা আশেকান ভক্তদের নৌ-পথে নিরাপতে যাতায়াতের ব্যবস্থা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা প্রস্তÍুত রয়েছে।

প্রতি বছরের (৩১মার্চ)১৭চৈত্র থেকে পরবর্তী ৭দিন ব্যাপী থেকে শুরু হয় চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের বদরপুরের বেলতলীতে সপ্তাহ ব্যাপী শাহ্ সোলেমান লেংটা পাগলের মেলা। এবার পালিত হচ্ছে শাহ্ সোলেমান লেংটার ৯৮তম ওরশ শরীফ। শাহ্ সোলেমান লেংটার ওফাত দিবস উপলক্ষে গত ৯৭ টি বছর যাবত উদযাপিত হয়ে আসছে ৭ দিনব্যাপী মেলা। তবে ওরশ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে ও পরে ১ মাস পর্যন্ত মেলা স্থায়ী হয়। এছাড়া প্রতি বছর ভাদ্র মাসে ও সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাজারে ভক্তদের আগমন ঘটে। চৈত্র মাসের ১৭ তারিখের মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক ভক্ত, আশেকান ও সাধারণ জনগণ আসা যাওয়া করেন।

স্থানীয়দের মতে বেলতলীর বদরপুর গ্রামে সোলেমান শাহ্ নামে এক ফকিরের মাজার আছে। এই মাজারই ল্যাংটা ফকিরের মাজার হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে, সোলেমান শাহ্ জীবদ্দশায় একটুকরো কাপড় দিয়ে লজ্জাস্থান ডেকে রাখতো বলে, তাকে লেংটা পাগল ডাকতো সবাই।

প্রতি বছর এ অসংখ্য বক্তরাই লেংটার মেলার আয়োজন করে। প্রতি বছর ৩১ মার্চ শুরু হয় এ মেলা, শেষ হয় ৬ই এপ্রিল। নামে লেংটা হলেও আদতে এখানে আশা পাগলেরা কেউই লেংটা নন। তবে তারা ভাবের পাগল। শাহ্ সোলেমান শাহ্র জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা থানার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মতলবের বদরপুরের এ বেলতলীর তার বোনের বাড়ীতে। সেখানে থেকে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী গ্রামে তিনি বিয়ে করেন। অনেকেই দাবী করেন তার বংশধর এখনও আছে। সোলেমান শাহ্ কাউকে মুরিদ করেননি। তবে মতলব তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি ও অগণিত ভক্ত। প্রতিবছর অগণিত ভক্ত এ ল্যাংটা মেলার আয়োজন করে থাকে। বাংলা ১৩২৫ সালের ১৭ চৈত্র সোলেমান শাহ বেলতর্লী বদরপুর তার বোনের বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮ চৈত্র তাকে বদপুরের এই বেলতলীতে (যেখানে মাজার) দাফন করা হয় বলে মাজার পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা খাদেম মোঃ দেলোয়ার হোসেন মোল্লা জানান। তারপর ভক্তরা তার বোনের বাড়ীতে মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় বেলতলীতে সপ্তাহ ব্যাপী লেংটা পাগলের মেলা। যদিও তার মৃত্যু তারিখের দু’একদিন আগে পড়ে এখানেই ৭ দিন ব্যাপী ওরশ হতো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লঞ্চ, ট্রলার, বাস, মিনি বাস, ট্রাক, মেক্সী, প্রাইভেটকার যোগে ওরশে আসে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ। তাঁরা নিয়ে আসেন গরু, মহিষ, ছাগল, মোরগ, ডিম, ডাল, চাউল, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন মানতি জিনিসপত্র। ল্যাংটার মেলায় একদিকে আনন্দের হিল্লোল অন্যদিকে বসে গাঁজার রমরমা আসর।
সারা বছর এ মাজারটি অর্থ পাওয়ার সেক্টরে পরিণত হয়েছে। এর ব্যতিক্রম কিছু করার জন্য এ বছর ওরশ পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্তরা লেংটা বাবার দরবারে পূন্য, রোগমুক্তিসহ বিভিন্ন কামনা-বাসনা নিয়ে আসেন। এছাড়াও ঢোল-কারার মাধ্যমে বাবার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় গান ও মজমা বসায় পূন্যের আশায়। মাজার কমিটি প্রতিবছর ভাল অংকের টাকাও উপার্জন করে থাকে। আর এ মাজারে দেওয়া মানতি টাকা কতিপয় কয়েকজনের পকেটে। এ টাকা নিয়ে চলে মারামারি। এ টাকা কোথায় যায় কে জানে। দোকান বসে প্রায় ৫ সহস্রাধিক। মেলা চলাকালীন ছোট দোকানে ভাড়া দিচ্ছে ১ সপ্তাহের জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। মিষ্টির দোকান ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, খেলনার দোকান ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এমনিভাবে অসংখ্য টাকা উঠছে মেলা উপলক্ষ্যে।
এছাড়া কতেক ভক্ত রয়েছেন তারা ল্যাংটা বাবার মাজার জেয়ারত করছেন এবং জিকির আসকার করে ঢোল বাদ্য,বাজনা বাজিয়ে মাজার ত্যাগ করছেন। কারণ তাদের মতে, ল্যাংটা ফকির ছিলেন একজন ভালো লোক। মেলাকে ঘিরে সোমবার থেকেই অসংখ্য পাগল ও ভক্তবৃন্দদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে মতলবের বেলতলী।
লেংটার মেলায় প্রতিদিন লক্ষাধীক লোকের ভীর ও দূর-দুরান্ত থেকে আসা অসংখ্য লোকের তত্বাবধানকরতে সমস্যা হয় কি না প্রসংগে জানতে চাওয়া হলে মেলার প্রধান তত্বাবধানকারী সাদুল্যাপুর ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও দীর্ঘ্যদিনের অভ্যাসের কারনে এখন আর কোন সমস্যা মনে করিনা। তাছাড়া স্থানীয় লোকজন একাজে অনেক সহযোগীতা করে থাকেন।

মতলব উত্তর থানা অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন মজুমদার বলেন, অতীতে কি হয়েছে, তা নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখনকার বিষয় হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বদা প্রস্তÍুত রয়েছে। ইতিমধ্যে মেলা প্রাঙ্গন শতাধিক সিসি ক্যামরার মাধ্যমে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলা চলাকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি যাতে সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক থাকে তার জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এদিকে সপ্তাহ ব্যাপী শাহ্ সোলেমান শাহ্ লেংটার মেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া (বীর বিক্রম) এমপির সুযোগ্য নাতি ও কেন্দ্রীয় আ’লীগ নেতা সাজেদুল হোসেন চৌধুরী দিপুর সুযোগ্য পুত্র মেধাবী ছাত্র মতলব ইয়ং ক্লাবের সভাপতি মোঃ আশফাক হোসেন চৌধুরী মাহির উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ঔষধ, শরবত ও খাবার পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি মেডিকেল টিমও মোতায়েন করা হয়েছে।

খান মোহাম্মদ কামাল, মতলব (চাঁদপুর)
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ০০ এএম, ৩ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার
ডিএইচ

Share