তথ্য প্রযুক্তি

জমি কেনাবেচার ঝামেলা কমাতে দলিল ডটকম

না জানার কারণে জমিজমা কেনাবেচা বা হস্তান্তরের কাজগুলো সম্পন্ন করতে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষজনকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটে থাকে এক শ্রেণির দালাল। মানুষকে জমিজমা সংক্রান্ত কার্যাবলির বিষয়ে আত্মনির্ভরশীল করতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে দলিল.কম। ওয়েবসাইটটি ভূমিসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নানা রকম তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন রিয়াদ আরিফিন

জমিসংক্রান্ত যাবতীয় রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধনের কাজ হয়ে থাকে নির্দিষ্ট উপজেলা/সার্কেল সাব-রেজিস্ট্রেশন অফিসে। ক্রয়, দান, বণ্টন কিংবা অন্য কোনোভাবে জমির মালিকানাপ্রাপ্ত হওয়ার পর সেই মালিকানার দলিলসহ উপজেলা/সার্কেল ভূমি অফিসে এসি ল্যান্ড বরাবর নামজারি বা খারিজের (মিউটেশন) আবেদন করতে হয়।

ভূমিসংক্রান্ত কাজগুলো সহজ করতে সরকারের পক্ষে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এখন ঘরে বসেই ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রায় সব উপজেলা/সার্কেলে নামজারির আবেদন করা যায়; কিন্তু এ ক্ষেত্রেও আমাদের জানার অভাবে দালালচক্রের ফাঁদে পড়তে হয়।

মানুষকে জমিজমা সংক্রান্ত কার্যাবলির বিষয়ে আত্মনির্ভরশীল করতে দুজন সাবরেজিস্ট্রার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন দলিল ডটকম (http://dolil.com/) নামের একটি ওয়েবসাইট। এটি ভূমিসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি দিয়ে সাজানো হয়েছে। ওয়েবসাইটির হোম পেজে গেলে অনেক অপশন বা মেন্যু পাওয়া যাবে।

ফিস ক্যালকুলেটর

বিভিন্ন এলাকার জমির অবস্থান, প্রকৃতি ও ধরনভেদে বিভিন্ন প্রকার দলিলের রেজিস্ট্রেশন খরচ ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচের তারতম্য হয়ে থাকে এবং এগুলো সরকারি আইন দ্বারা নির্ধারিত। তবে কোন ধরনের দলিল রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধনে খরচ কত হবে, তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই দলিল লেখকরা অধিক হারে অর্থ দাবি করে থাকেন। এ জন্য যেকোনো ধরনের দলিল নিবন্ধনে কত খরচ, তা বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাবে দলিল.কমের এই ফিস ক্যালকুলেটর অপশন থেকে। পেজটিতে গিয়ে দলিলের প্রকৃতি, জমির অবস্থান, সম্পত্তির মূল্য প্রভৃতি তথ্য দিয়ে ফলাফলে ক্লিক করলে দলিলটি রেজিস্ট্রেশনে সর্বমোট কত টাকা প্রয়োজন তা জেনে নেওয়া যাবে; এমনকি সেই অর্থ কোন খাতে কত পরিমাণে এবং তা কিভাবে কোথায় জমা দিতে হবে, সেটাও জেনে নেওয়া যাবে।

ফিস ক্যালকুলেটরের মতো একটি সমন্বিত ক্যালকুলেটর তৈরির ব্যাপারটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। এটি তৈরি করতে দীর্ঘ সময়ও লেগেছে বলে জানিয়েছেন ওয়েবসাইটটির নির্মাতারা। এ ছাড়া তাঁদের দাবি, এই ওয়েবসাইটে থাকা ফিস ক্যালকুলেটরে প্রয়োজনীয় সব তথ্যে সঠিক ইনপুট দিলে ফির যে পরিমাণ অর্থ প্রদর্শিত হবে, তা প্রায় শতভাগ নির্ভরযোগ্য। চাইলে প্রাপ্ত ফলাফল প্রিন্টও করে নেওয়া যাবে ওয়েবসাইট থেকে।

দলিল পরিচিতি ও দলিল নমুনা ফরম

কোন ধরনের কাজে কী দলিল হবে, তা অনেকেই হয়তো জানি না। দলিল করার সময় নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি কিংবা আইনগত অসংগতি থাকলে সেটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জমির মালিকানাও হারাতে হতে পারে। দলিল.কমের দলিল পরিচিতি অপশনে গিয়ে সব ধরনের দলিল সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাবে। শুধু তা-ই নয়, সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার্থে ওয়েবসাইটিতে নানা ধরনের দলিলের নমুনা ফরমও যুক্ত করা হয়েছে। চাইলে সেগুলো পিডিএফ এবং ডক ফরম্যাটে ডাউনলোড করেও ব্যবহার করা যাবে।

সর্বনিম্ন বাজারমূল্য

প্রতিটি এলাকার জমির সরকার নির্ধারিত বাজারমূল্য থাকে, যা নির্দিষ্ট সময় পর পর পরিবর্তিত হতে পারে। সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বাজারমূল্যের নিচে কোনো জমি কেনাবেচা করা যায় না। প্রায় সব এলাকার ক্ষেত্রে হালনাগাদ এই মূল্যতালিকা পাওয়া যাবে দলিল ডটকমে। এ জন্য বিভাগ, জেলা ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নাম প্রদান করে তালিকা দেখা কিংবা ডাউনলোড করে নেওয়া যাবে।

ওয়েবসাইট নির্মাতাদের দাবি, তাঁদের ওয়েবসাইটই একমাত্র প্ল্যাটফর্ম, যেখানে ৪৮০টি উপজেলা বা সার্কেলের মৌজা ও ধরনভিত্তিক জমির সর্বনিম্ন বাজারমূল্যের তালিকা রয়েছে, যেগুলো তাঁরা ব্যক্তি উদ্যোগেই সংগ্রহ করেছেন এবং নিয়মিত হালনাগাদও করে যাচ্ছেন।

আইন ও বিধিমালা

জমিজমা রেজিস্ট্রেশনসংক্রান্ত যাবতীয় আইন এবং বিভিন্ন সময়ে জারীকৃত পরিপত্রগুলো পাওয়া যাবে এই অংশে। এই মেন্যুর ভেতরে নানা ক্যাটাগরি বা বিষয় মোতাবেক আইন ও পরিপত্রগুলো সাজানো রয়েছে। এতে সহজে প্রয়োজনীয় পরিপত্রটি খুঁজে পাওয়া যাবে।

তল্লাশ ও নকল

বিভিন্ন সময় জমির মালিকানা যাচাইয়ের জন্য কিংবা মূল দলিল হারিয়ে গেলে দলিল খোঁজা বা তল্লাশের প্রয়োজন পড়ে। এ ছাড়া মূল দলিলের ‘সার্টিফায়েড কপি’ বা ‘অবিকল নকল’ তুলে নিতে প্রয়োজন হয়। এই কাজের বিস্তারিত প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় ফরম পাওয়া যাবে ওয়েবসাইটটির ‘তল্লাশ ও নকল অংশে’।

নামজারি বা মিউটেশন/খারিজ

দলিলের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়, বণ্টন কিংবা অন্য যেকোনো উপায়ে জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে সরকারি রেকর্ডে সেটির তথ্য হালনাগাদ করাকে মূলত নামজারি (মিউটেশন) বলা হয়। এ কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ এটি কিভাবে করতে হয় তা জানা যাবে এই ওয়েবসাইটে।

সরকারি সেবাসমূহ

ভূমি সংক্রান্ত সরকারি নানা রকম অনলাইন সেবার লিংক দেওয়া আছে ওয়েবসাইটটিতে। ওয়েবসাইট থেকেই ‘উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর’ ব্যবহার করে পারিবারিক সম্পত্তির হিসসা বা অংশ বের করা যাবে। এ ছাড়া আরএস খতিয়ান বা পরচা যাচাই, আবেদন ও ডাউনলোডের সরকারি ওয়েবসাইটের লিংকও পাওয়া যাবে এখানে।

চাইলে ওয়েবসাইটি থেকেই যাওয়া যাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ‘ডিজিটাল (ভার্চুয়াল) রেকর্ডরুমে’। নামজারি বা মিউটেশনের সরকারি অনলাইন সেবা ই-মিউটেশনের ওয়েব ঠিকানাও আছে এতে।

আছে আরো কিছু সুবিধা

এ ছাড়া জাল দলিল যাচাই কিভাবে করা যাবে তা-ও জানা যাবে ওয়েবসাইটটিতে। শুধু তাই নয়, কোনো জমি ক্রয়ের আগে একজন ক্রেতার কী কী বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া উচিত এবং সেগুলো কিভাবে সহজে করা যাবে, সেগুলোর বিস্তারিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যাবে সাইটটিতে।

দলিল লেখকদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও যাবতীয় ফরম আছে ‘দলিল লেখক’ অংশে। এ ছাড়া নিবন্ধন ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নিবিষয়ক তথ্যাবলি যুক্ত হয়েছে ওয়েবসাইটটিতে।

অ্যাপও আছে

দলিল ডটকম ওয়েবসাইটের পাশাপাশি রয়েছে একটি মোবাইল অ্যাপও। আপাতত শুধু অ্যানড্রয়েড প্ল্যাটফর্মের জন্য এই অ্যাপ সুবিধা থাকলেও শিগগিরই আইওএসের জন্য উন্মুক্ত করা হবে অ্যাপটি।

অ্যানড্রয়েডের জন্য অ্যাপ ওয়েবসাইট থেকে এপিকে ফরম্যাটের ফাইল ডাউনলোড করে মোবাইলে ইনস্টল করা যাবে।

তাঁরা দলিল ডটকমের নির্মাতা

ওয়েবসাইটির দুই নির্মাতা হচ্ছেন—বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের সাবরেজিস্ট্রার মো. জুবায়ের হোসেন এবং কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সাবরেজিস্ট্রার মো. মকছু মিয়া।

এই ওয়েবসাইটটি তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা বলেন, ‘২০১৭ সালের মাঝামাঝি চাকরিতে যোগ দিই দুজনেই। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে নিজেদেরও ভূমিবিষয়ক তেমন কোনো ধারণা ছিল না। কাজে যোগ দেওয়ার পর লক্ষ করি ভূমির মতো একটি মৌলিক বিষয়ে বেশির ভাগ শিক্ষিত জনসাধারণের তেমন কোনো ধারণাই নেই। এ কারণে জমিবিষয়ক নানা কাজে জনগণের যেমন বেগ পেতে হয়, তেমনি এসব কাজে সরকারি দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেগ পেতে হয়। তাঁদের সাহায্য করার ভাবনা থেকেই এমন একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের আইডিয়া মাথায় আসে, যেখানে সেবাপ্রত্যাশী জনগণ থেকে শুরু করে ভূমিবিষয়ক সেবা প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট সবাই উপকৃত হবেন।’

বার্তা কক্ষ,৬ ডিসেম্বর ২০২০

Share