Home / সারাদেশ / জন্ম-মৃত্যুর ডিজিটাল নিবন্ধনে বেড়েছে ভোগান্তি
জন্ম

জন্ম-মৃত্যুর ডিজিটাল নিবন্ধনে বেড়েছে ভোগান্তি

ভাঙনে ঘর হারিয়ে গ্রাম ছাড়েন শেফালি আক্তার। বর্তমানে রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারে ভাড়া বাসায় তার বসবাস। দুই সন্তানের জন্য ডিজিটাল জন্মসনদ নিতে এসেছেন গোলাপবাগের ঢাকা দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৮ এর অফিসে। সঙ্গে এনেছেন ভাড়া বাসার বিদ্যুৎ বিলের কাগজ। কিন্তু বিলটি বাড়ির মালিকের নামে, যা জমা নিয়ে জন্মসনদ দিতে নারাজ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। ফলে সনদের আবেদনই করতে পারছেন না তিনি। এ নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন শেফালি আক্তার।

সন্তানের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে ভোগান্তি নিয়ে ক্ষুব্ধ শেফালি বলেন, নিজস্ব বাড়ি তো আমার নেই, বিলটা আমার নামে হবে কীভাবে? তারা (কর্মকর্তা) আবেদনও নিচ্ছেন না, সেভাবে কথাও বলছেন না। কাজ-কর্ম ফেলে এতদূরে ক’দিন আসা যায়? খুব সমস্যায় পড়ে গেছি।

‘আগেও সন্তানের জন্মনিবন্ধন করিয়েছি। এখন আবার ডিজিটাল জন্মসনদ লাগবে। বাইরের দোকান থেকে অনলাইনে আবেদন করেছি। বাড়িওয়ালার বিলের কাগজ এনেছি, তাতে কাজ হচ্ছে না। নিজের নামে বিদ্যুৎ বিলের কাগজ লাগবে। আমার তো তা নেই।’

শুধু শেফালি বেগম নন, ডিজিটাল জন্ম ও মৃত্যুসনদ নিতে পদে পদে এমন ‘ডিজিটাল বিড়ম্বনায়’ পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা। অথচ সেবা সহজ করতে অনলাইনে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে সরকার। উল্টো সেখানেই বেড়েছে জটিলতা। পাশাপাশি জনবলসহ নানান সংকটে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন জোন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০১ সালের পর যাদের জন্ম, তাদের জন্মনিবন্ধনের জন্য বাবা-মায়ের জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করায় সন্তানের জন্মসনদ নিতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে অভিভাবকদের। একই সঙ্গে কারও মৃত্যুসনদ নিতে হলে প্রয়োজন হচ্ছে ডিজিটাল জন্মসনদের। সব মিলিয়ে চরম জটিলতায় পড়ছেন সেবাগ্রহীতারা।

জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নাগরিকের ১৮টি সেবা পেতে জন্মনিবন্ধন সনদ এবং চারটি সেবা পেতে মৃত্যু নিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়। ২০০৭ সালে ভোটার তালিকা তৈরির কার্যক্রম শুরু হলেও ২০০১-২০০৬ সালে ২৮টি জেলায় ও চারটি সিটি করপোরেশনে জন্মনিবন্ধনের কাজ শুরু হয়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সনদ দেওয়ার জন্য অফিস ও জনবল সংকটে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। নতুন করে কিছু অঞ্চল যুক্ত হওয়ায় এক অঞ্চলের অফিসেই তিন অঞ্চলের সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। ফলে এক অঞ্চলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন অঞ্চলের নাগরিকদের সেবা দিতে হচ্ছে, যা খুবই কষ্টসাধ্য।

এদিকে, মৃত্যুসনদ নিতেও ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেকে। তাদেরই একজন জয়নুল আবেদিন। মৃত বাবার মৃত্যু নিবন্ধন সনদ নিতে এসে জটিলতায় পড়েছেন তিনি। বাবার জন্মসনদ ডিজিটাল না হওয়ায় মৃত্যুসনদের আবেদন নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। সমস্যা সমাধানে জোন অফিসে এসেছেন জয়নুল। তবে জোন অফিস থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ডিজিটাল জন্মসনদ ছাড়া মৃত্যু নিবন্ধন সনদ দেওয়া হবে না। ফলে বাবার রেখে যাওয়া জমি ও সম্পদ নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন তিনি।

জয়নুল আবেদিন জাগো নিউজকে বলেন, ১৫ দিন আগে বাবা মারা গেছেন। তার মৃত্যু নিবন্ধনের আবেদন করলেও সেটি নিচ্ছেন না কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নম্বর ছাড়া মৃত্যু নিবন্ধন আবেদন করাই যাবে না। এখন জন্মনিবন্ধন কীভাবে করাবো বুঝতে পারছি না। পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

জোন অফিসের কর্মকর্তারা বলছেন, বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) নম্বর দিয়েই আগে সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করার সুযোগ ছিল। তবে এখন নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে। সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

তথ্য জেনে আবেদন করলে জটিলতার কোনো কারণ নেই বলে দাবি দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, সেবা নিতে আসা অনেকেই বিষয়টি না জানায় জটিলতার অভিযোগ করছেন। যেহেতু নিয়ম করা হয়েছে, তাই আমাদের কিছু করার নেই। সঠিকভাবে সব কাগজপত্র না দিলে আমরা নিবন্ধন করাতে পারবো না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৮ এর নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, নতুন অঞ্চলগুলোতে এখনো লোকবল নিয়োগ হয়নি। সেজন্য পুরোনো অঞ্চলের যারা স্টাফ, তারাই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তিন অঞ্চলের কাজ এক অঞ্চল থেকে করা হচ্ছে। সেজন্য চাপটা বেশি। তারপরও আমরা বাড়তি সময় কাজ করে যথাসময়ে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ বলেন, পুরোনো পাঁচ অঞ্চলের সঙ্গে নতুন আরও পাঁচটি অঞ্চল করা হয়েছে। তবে সেগুলোর অফিস স্ট্যাবলিশমেন্ট করা হয়নি। নতুন আরও পাঁচটি অঞ্চলে অফিস করা হবে। সেখানে বিভিন্ন স্ট্যাবলিশমেন্ট স্বাস্থ্য, প্রকৌশল, রাজস্ব সব অফিস হবে। সবকিছুই পরিকল্পনায় আছে এবং ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করা হবে।

‘এটা তো একদিনে সম্ভব নয়। ঢাকা শহরে জায়গা পাওয়াটাও বড় সমস্যা। অফিসগুলো যখন হবে আর সমস্যা থাকবে না। লোকবল নেওয়া হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বিভাগে লোক নেওয়া হচ্ছে।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের ফরম্যাট সফটওয়্যারের মাধ্যমে হয়, সেটা জন্মনিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে করা হয়। এখানে আমাদের কর্মকর্তাদের তেমন কিছুই করার নেই। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দিলে সেখান থেকে (অনলাইনে) নিবন্ধন সনদ ডাউনলোড করা যায়। সেটা আমরা সেবা নিতে আসাদের হাতে পৌঁছে দেই। তবে অনেক সময় সার্ভার ডাউন থাকে, স্লো কাজ করে। আবার অনেক সময় বন্ধও থাকে। এসব সমস্যায় আমাদের কিছু করার নেই।

জন্মসনদ নিতে বাগেরহাটের একটি ইউনিয়ন পরিষদে অভিভাবকদের ভিড়।

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ ভোগান্তির শিকার হয়, তা আমরা জানি। কিছু সিস্টেম আছে যেগুলো জটিল। যেমন- ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের জন্মনিবন্ধনও থাকতে হবে। যাদের এটা করা নেই, তারা বলে করে দেন। কিন্তু করে দেওয়ার তো সুযোগ নেই। সফটওয়্যারে বাবা-মায়ের জন্মনিবন্ধন নম্বর না দিলে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের পরবর্তী পেজ আসে না। এ ধরনের কিছু জটিলতা থাকে, এটা অনেকটাই ডিজিটাল জটিলতা।’

আবেদনকারীরা সঠিক ডকুমেন্ট দিতে পারেন না জানিয়ে সিটি করপোরেশনের এ কর্মকর্তা বলেন, সব সময় সঠিক ডকুমেন্ট আসে না। যেমন- জন্ম তারিখটার জন্য অবশ্যই বৈধ ডকুমেন্ট থাকা দরকার। সেটা এনআইডি হতে পারে, শিক্ষাগত সনদের কপি হতে পারে কিংবা টিকা কার্ড হলেও চলবে। মানুষ সেগুলো দিতে পারেন না। কিছুদিন আগে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন দিবস পালন হলো, সেখানেও এ কথাগুলো উঠে এসেছে। এ সেবা প্রক্রিয়া কীভাবে জনবান্ধব ও ভোগান্তিমুক্ত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, চাইলেই আমি লোকবল বাড়িয়ে দিতে পারবো না। এটা সরকারেরই একটা পলিসি, কিছু জনবল শর্টেজ (সংকট) নিয়েই সব জায়গায় কাজ করা হচ্ছে। সেজন্য আমি কখনই বলি না, আমার জনবল সংকট আছে বলে আমি পারি না। আমার এফিসিয়েন্সি বাড়াতে হবে, সেভাবে মেকআপ করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব মানুষকে সেবা দেওয়ার জন্য অফিসারদের ইনকারেজ করি এবং সেভাবেই কাজ হচ্ছে।

জন্মনিবন্ধনে ভুল তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধনে অনলাইন যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সেখানে আমাদের কর্মকর্তাদের কোনো ভূমিকা নেই। আবেদনকারীরা যেভাবে ফিলআপ করবেন, সেটাই প্রিন্ট হয়ে আসবে। সঠিক তথ্য দিলে সঠিক নিবন্ধন আসবে। খুব দ্রুতই প্রত্যেকটি এলাকায় অফিস হবে। শিগগির ভোগান্তি কমবে।’

জানতে চাইলে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মুস্তাকীম বিল্লাহ ফারুকীবলেন, ভোগান্তির বিষয়টি আসছে কীভাবে? যে ফরম দেওয়া হয়, সেখানে তো সব লেখা থাকে। কোন কোন কাগজপত্র ও কত টাকা ফিস জমা দিতে হবে, তাও সেখানে থাকে। সঠিকভাবে সাবমিট করলে ভোগান্তির কোনো অবকাশ নেই।’

তিনি বলেন, তবুও যদি কোনো ভোগান্তির বিষয় সামনে আসে, তার কোনো নমুনা আমাদের জানালে খতিয়ে দেখবো। কেউ মারা গেলে তার মৃত্যু নিবন্ধন সনদের জন্য আগে জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন হয়। সেটা কারও না থাকলে তার পক্ষে পরিবারের যে কেউ জন্মগ্রহণ সংক্রান্ত তথ্যসহ জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেন।

এক অঞ্চলের অফিসে কয়েক অঞ্চলের সেবা দেওয়া প্রসঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, এ অফিসগুলো আমাদের নয়, সিটি করপোরেশনের। কোন অঞ্চলের অফিস কোথায়, সেটা ওয়েবসাইটে বলা আছে। নির্ধারিত টেলিফোন নম্বরে কল দিয়েও তথ্য জানা যাবে।