প্রতিবছর ১১ জুলাই পৃথিবীজুড়ে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয় । যার লক্ষ্য বিশ্ব জনসংখ্যা–সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ও তার প্রতিকারের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটি পূর্ণ হওয়ার পর বিশ্বের ৯০টি দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি সভায় বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় । ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির পরিচালনা পর্ষদ এ দিবসটি প্রতিষ্ঠা করে।
ইউএনডিপির গভর্ন্যান্স কাউন্সিল কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অতি আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়। এরপর থেকে জনসংখ্যা সমস্যার গুরুত্ব ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন চিন্তা করে প্রতিবছর বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো পরিবার পরিকল্পনা, লৈঙ্গিক সমতা, দারিদ্র্য, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো জনসংখ্যা–সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি,জনসংখ্যাবিষয়ক নানাবিধ সমস্যাগুলো সবাইকে অবহিতকরণ এবং তা গুরুত্ব অনুসারে সমাধান করা।
একটি রাষ্ট্রের যে কয়েকটি মৌলিক উপাদান রয়েছে, তার মধ্যে জনসংখ্যা অন্যতম। আর এ জনসংখ্যা কোনো দেশের জন্য সম্পদ আবার কোনো দেশের জন্য বোঝা। অনেক দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় না এনে,তাদের বোঝা হিসেবে বিবেচনায় নেয়। তবে সমসাময়িক প্রযুক্তি, যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা এবং উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অতিরিক্ত জনসংখ্যা দক্ষতাসম্পন্ন করতে পারলে তা সম্পদে পরিণত করা সম্ভব।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে,বাংলাদেশে জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে,তা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে আমাদের লোকসংখ্যা ২৩ কোটি অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে। জনসংখ্যা সমস্যা নিয়ে কিছুটা বিতর্কও আছে। অনেকের মতে,পৃথিবীতে যা সম্পদ রয়েছে তাতে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি লোকের স্বাচ্ছন্দ্যময় বসবাস করার উপযোগী। তাদের মতে, ধীরে ধীরে পৃথিবীর সব দেশের জনসংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত।
ইউএনএফপিএর তথ্যমতে, ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ৪০ কোটি। ৭৫০ বছরে তা দ্বিগুণ হয়। এরপর থেকে জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১০০ বছরে দ্বিগুণ,বর্তমানে মাত্র ৫০ বছরে দ্বিগুণিতক হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। এমনকি জনবিস্ফোরণের অবস্থা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে এ অতিসহনশীল বসুন্ধরা।
পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ প্রবণতা খুব বেশি আগের নয়। মূলত কৃষিবিপ্লবই জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এর পূর্বেকার সময় খাদ্যাভাব পরোক্ষভাবে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে আশার কথা হলো,উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
দেশে ১৯৭০ সাল থেকে প্রজননহার কমতে থাকার বিপরীতে পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার সুফলভোগীদের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। মা ও শিশু সুরক্ষা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে উল্লেখযোগ্যভাবে সক্ষম হওয়ায় ২০১০ সালে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
মানবকুলের জন্য বড় বিপর্যয় হচ্ছে মাটি-পানি-বায়ুদূষণ,বৈশ্বিক উষ্ণায়ন,প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার-অপব্যবহার ও গ্রিনহাউস অ্যাফেক্ট। প্রকৃতিকে তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেওয়ার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক না কেন,মানুষের খাদ্য চাহিদার জোগান দিতে গিয়ে প্রকৃতি কিন্তু ক্রমেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে এবং মানব বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় এবং শহরকেন্দ্রিক জনস্রোত বৃদ্ধি পাওয়ায় সুপেয় পানি,স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যবস্থা আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। নগরায়ণ,নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস,জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।
সে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব-বিবাদ, পেশিশক্তি প্রদর্শনে মানবসভ্যতার জন্য হুমকি নানান মারণাস্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহার এবং নানা কারণে বাস্তুচ্যুতি ও জোরপূর্বক অভিবাসন তো রয়েছেই। এসব দুর্যোগ ও দ্বন্দ্বে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর অপুষ্টি,মাদকের সহজলভ্যতা এবং তরুণ-যুব সমাজের ওপর এর করাল থাবা ও শব্দদূষণ তো এখন প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।
দেশ,রাষ্ট্র আর নিখিল বিশ্বের অন্যতম মূল উপাদান হলো জনসংখ্যা। এ জনসংখ্যাকে পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও কৌশলভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
লেখক : ড.আবদুল আলীম তালুকদার , ১১ জুলাই ২০২১