রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীদের যে পাঁচজনের ছবি পুলিশের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন ওই রেস্তোরাঁর কর্মচারী বলে দাবি করছে নিহতের পরিবার। একই দাবি করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। শেফের পোশাক পরিহিত নিহতের ছবির সাথে তার পরিবারের সরবরাহ করা ছবির পুরোপুরি মিল পাওয়া গেছে।
নিহত শেফের আরও ছবি ও পরিচয় পেয়েছে প্রিয়.কম। তার নাম সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কলুকাঠি গ্রামে। মৃত আবুল হাসেম চৌকিদারের ৫ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সাইফুল। দীর্ঘ ১০ বছর জার্মানিতে থাকার পরে দেড় বছর আগে দেশে ফিরে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে শেফ হিসেবে কাজ শুরু করেন সাইফুল।
পরিবারের লোকজন জানান, সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া সাত মাসের অন্তঃস্বত্তা। আর ক’দিন গেলেই তৃতীয় সন্তানের বাবা হতেন তিনি।
এদিকে পুলিশের সরবরাহকৃত পাঁচ জঙ্গির ছবিতে সাইফুলের ছবি থাকলেও ফোকাস বাংলার সরবরাহ করা মৃতদেহের ছবিতে শেফের পোশাক পরা কাউকে দেখা যায়নি। অর্থাৎ সাইফুলের মৃতদেহ নেই। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে।
রোববার দুপুরে সাইফুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিহত সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের অন্তঃস্বত্তা স্ত্রী সোনিয়া আকতার (২৭) তার দুই কন্যা সামিয়া (১০) ও ইমলিকে (৭) নিয়ে বাড়িতে আহাজারি করছেন। পাশের ঘরে মা সমেরা বেগমের (৭০) আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। সাইফুলে মায়ের বুকফাটা কান্না দেখে স্বজনেরা তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। বারবার ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে সকলের সঙ্গে একসাথে ঈদ করার কথা ছিল সাইফুলের।
নিহত সাইফুলের স্ত্রী সোনিয়া কান্না জড়িত কন্ঠে জানান, গত শুক্রবার বিকেলে সোনিয়ার সাথে তার শেষ কথা হয়। ঘটনার সংবাদ পেয়ে বার বার তাকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ঢাকায় থাকা তার স্বজনেরা খোজ নিয়ে তার লাশ শনাক্ত করে বাড়িতে খবর দেয়।
সোনিয়া বলেন, ‘আমার দুটি মেয়ে এবং অনাগত সন্তানের কি হবে। ওরা কাকে বাবা বলে ডাকবে। কি করে আমি বাঁচব?’
সাইফুলের মা সমেরা বেগম বলেন, ‘আর কত মায়ের বুক খালি হবে। আমার বাবা কে কি তোমরা এনে দিতে পারবে? ’
এরইমধ্যে ফেসবুকে উপরের ছবিটি অসংখ্যবার শেয়ার করা হয়েছে। ছবি পোস্টকারী এবং মন্তব্যকারীরা সবাই পুলিশ কেন তার ছবি হামলাকারী বলে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সে প্রশ্ন রেখেছেন। একইসাথে তারা নিহত ব্যক্তিকে যেন জঙ্গি আখ্যা না দেওয়া হয় সেই আহ্বান জানিয়েছেন।
শামস আহমেদ নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ছবিটি প্রকাশ করে লিখেছেন ‘এই লোক একজন হোটেলের কর্মচারী ছিল। সে তো সেই অপারেশনে মারা যায়। তাহলে সন্ত্রাস বলে তাকে চালিয়ে দিল কেন?’
সাকের খন্দকার নামে একজন ছবিটি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘ফেসবুকের বিভিন্ন শেয়ারে হামলাকারীদের ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মানুষটি পরিস্কারভাবেই একজন শেফ, যিনি সেখানে কাজ করতেন। এবং ঘটনার রাতে তার মা তাকে খুঁজে পেতে সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। দয়া করে তাকে জঙ্গি বলে শনাক্ত করবেন না।’
একই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সুমিত বড়ুয়া নামে একজন লিখেছেন, ‘সে ঐ রেস্টুরেন্টের প্রধান শেফ ছিল। তাই দয়া করে তাকে জঙ্গি বলে প্রচার করবেন না।’
এর আগে সুমিত বড়ুয়া উপরের ছবিটি পোস্ট করে ফেসবুকে লেখেন, ‘বাম পাশে নিহত ৫ জন জঙ্গির লাশ। পুলিশও এই পাঁচ জনের ছবি প্রকাশ করেছে। কিন্তু ডান পাশে সাদা পোশাক পড়া লোকটি জঙ্গি না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ পাঁচ জনের লাইনে সাদা পোশাকের কেউ নাই। তার পরনে শেফ এর পোশাক। তাই ধারণা করি এই লোক একজন ভিকটিম। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই সকল অনলাইন পত্রপত্রিকায় ও ফেবু’র ওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই লোকের ছবি জঙ্গি হিসাবে। আমার ধারণা যদি সত্য হয় তাহলে একটি পুরা পরিবার ভিক্টিম হওয়ার সাথে সাথে সামাজিকভাবেও সব কিছু হারাবে।’
শনিবার রাত ১০টার দিকে বিতর্কিত মার্কিন ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্সের টুইটার হামলাকারীদের ছবিগুলো প্রকাশ করা হয়। এরপর রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) নিহত পাঁচ জঙ্গির মৃতদেহের ছবি এবং তাদের সংক্ষিপ্ত নামগুলো প্রকাশ করে।
ল্লেখ্য, গত ১ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে নয়টার দিকে গুলশানের ৭৯ নম্বরের আর্টিজান বেকারিতে ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী অতর্কিত হামলা চালায়। এরপর ওই রেস্তোরাঁয় থাকা ২০ জন বিদেশি নাগরিকসহ ৩০-৩৫ জন লোকজনকে জিম্মি করে রাখে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি হয়।
গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম এবং বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত হয়েছেন। আহত হন প্রায় ৩০ জন পুলিশ সদস্য। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন- ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন। আহতদের মধ্যে ১৯ জন গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
জঙ্গি হামলা চালিয়ে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করার ঘটনায় দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এই ধরনের অতর্কিত হামলা চালিয়ে মানুষজনকে জিম্মি করার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম।
শনিবার ভোরে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী অভিযান চালায়। চালিয়ে জিম্মি হওয়া ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করে এবং ২০ জন বিদেশি নাগরিকের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক।
এ ঘটনায় বাংলাদশে দুই দিনের শোক ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (প্রিয়.কম)
নিউজ ডেস্ক ।। আপডেট ০৮:৩৩ পিএম,০৩ জুলাই ২০১৬,রোববার
এইউ