১৭ বছর আগে দুই শিশু সন্তান রেখে মর্জিনা বেগমের স্বামী মারা যান। এরপর থেকেই শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। সংসারের হাল ধরতে কখনো অন্যের বাড়িতে, কখনো আবার কাজ করেছেন ফসলের মাঠে।
এখনও মর্জিনা বেগম কেয়ার বাংলাদেশের হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের একজন তালিকাভুক্ত মাটি কাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এই সংগ্রামী নারী তার ছেলেকে বানাচ্ছেন এমবিবিএস ডাক্তার।
ছেলে রিপন বিশ্বাস ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। মেয়ে সুরমা আক্তার এইচএসসি পরীক্ষার্থী। তাকেও আইনজীবী বানাতে চান মর্জিনা।
মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরুয়া ইউনিয়নের বাউলিকান্দা গ্রামে মর্জিনা বেগমের বাড়ি। স্বামীর নাম লালন বিশ্বাস। কাঠমিস্ত্রি স্বামী ঢাকায় কাজের খোঁজে গিয়ে আর ফিরেন নি। পরে জানতে পারেন তিনি মারা গেছেন। তখন ছেলের বয়স ৫ বছর। আর মেয়ের দেড় বছর। স্বামীর ভিটে বলতে কিছুই ছিল না। বাবার বাড়িতে ভাইয়ের সঙ্গে একটি ছাপড়া ঘর তুলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন মর্জিনা বেগম।
সরেজমিনে বাউলিকান্দা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মর্জিনা বেগম কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে একটি কাঁচা রাস্তা সংস্কারের কাজ করছেন। তপ্ত রোদে কোদাল চালাতে গিয়ে যেন ক্লান্ত তার দেহ।
আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মর্জিনা বেগম জানালেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছিলেন। সন্তানদের মুখে দু’বেলা দু`মুঠো ভাত জোটাতে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছেন। কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন ক্ষেত-খামারে। ছেলে রিপন বড় হওয়ার পর মায়ের সঙ্গে কাজ করতেন। ৫ বছর ধরে কেয়ার বাংলাদেশ এর তালিকাভুক্ত মাটি কাটা শ্রমিক তিনি। ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে রাস্তা তৈরি আর সংস্কার করাই তাদের কাজ।
মর্জিনা বেগম জানান, অভাবের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াকে আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশিরা বাঁকা চোখে দেখতো। তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু ছেলের একের পর এক ভালো রেজাল্টে সবাই খুশি হয়েছেন। এ পর্যন্ত আসার পেছনে এলাকাবাসীও অনেক আর্থিক সহযোগিতা করেছেন।
তিনি বলেন, ছেলেকে ডাক্তার বানানো আমার স্বপ্ন ছিল। ছেলেও আমার সে ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে লেখাপড়া করেছে। এজন্যই আমার স্বপ্ন আজ পূরণ হওয়ার পথে।
মুখে এক গাল তৃপ্তির হাসি হেসে তিনি জানান, আজ আর আমার কোনো কষ্ট নেই। আমি সব কষ্টের কথা ভুলে গেছি। ছেলে ডাক্তার হচ্ছে, গরিব দুখীর সেবা করতে পারবে। মেয়েকে উকিল বানাবে, যেন সেও মানুষকে আইনি সেবা দিতে পারে।
মর্জিনা বেগমের ছেলে রিপন বিশ্বাস পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিল। সবগুলো পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
হরিরামপুরের ভাদিয়াখোলা ফিরোজা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঢাকা আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য সমাজের বিভিন্ন কর্তা ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন রিপন। পরে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম আনোয়ারুল হকের মাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে যান তিনি। তার সুপারিশেই ঢাকার গ্রীন লাইফ মেডিকেল কলেজে দরিদ্র কোটায় ভর্তির সুযোগ পান রিপন। বর্তমানে তিনি এমবিবিএসের শেষ বর্ষের ছাত্র।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অধীনে সারাদেশের ৫ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষাবৃত্তি দিয়েছিলেন রিপন বিশ্বাসও তাদের একজন। মাসিক ২০০ টাকা করে প্রধানমন্ত্রীর সেই বৃত্তির টাকা এখনও পাচ্ছেন রিপন।
রিপন বিশ্বাস জানান, আমার মা মাটি কেটে আমাদের মানুষ করেছেন। আমার মায়ের মতো এতো পরিশ্রম ও মনের জোর থাকলে ডাক্তার কেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব। রিপনের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে গ্রামে মায়ের নামে একটি হাসপাতাল গড়ে তুলবেন। যেখানে এলাকার গরিব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হবে।
তিনি বলেন, মায়ের স্বপ্ন বোনকে আইনজীবী বানানো। সেই স্বপ্ন পূরণে বোনকেও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
রিপনের স্কুলশিক্ষক রানা হামিদ ছিতাপ জানান, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার জন্য মর্জিনা বেগম যে পরিশ্রম করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। নিজে দিন মজুরি করেছেন, প্রতিবেশি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহযোগিতার জন্য সার্বক্ষণিক চেষ্টা করেছেন। রিপন এখন আমাদের গর্ব। ভবিষ্যতে সে দেশের মঙ্গল বয়ে আনবে।
অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মধ্যে নয় একজন মাটি কাটা নারী শ্রমিক ছেলেকে ডাক্তার বানাচ্ছেন। মর্জিনা বেগমের এই সংগ্রামী গল্প গ্রামের সবার মুখে মুখে।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের `জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কার্যক্রমের আওতায় `সফল জননী নারী’ ক্যাটাগরিতে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নির্বাচিত হয়েছিলেন মর্জিনা বেগম। (জাগো নিউজ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৯:৪৫ পিএম, ১৭ মে ২০১৬, মঙ্গলবার
ডিএইচ