কেস স্ট্যাডি ১: নাদিয়া আনজুম বৃষ্টি। ইন্টারমেডিয়েট পাস করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বাবা-মা যশোর থেকে ঢাকায় পাঠান শান্ত-শিষ্ট আদুরে নাদিয়াকে। ২০০০/- টাকা মাসে আরো তিনটি মেয়ের সাথে আজিমপুর এলাকার একটি মেসে উঠে নাদিয়া। ঢাকায় আসার ১ মাসের মধ্যেই অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে আশ্চর্যরকম ভাবে পরিবর্তন আসতে শুরু হয় নাদিয়ার মাঝে।
যে মেয়েটি যশোরে মা-বাবার সাথে থাকার সময় রাত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ত সে এখন ঘুমাতে যায় ভোরের দিকে। সারারাত ফেসবুকেই কাটিয়ে বেশীরভাগ দিনই সকালে ঘুম থেকে উঠে কোচিং ক্লাসে যেতে পারেনি নাদিয়া। ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভাল করে প্রস্তুতি নিতে না পারায় ঢাবি, জাবি কোথাও চান্স পায়নি। এসএসসি-তে গোল্ডেন+ এবং এইচএসসি-তে জিপিএ ৫ পাওয়া নাদিয়া। শুরু হতাশার। কোথাও চান্স না পাওয়ার হতাশা থেকে মাঝে মাঝে নাদিয়ার ইচ্ছা হয় মরে যেতে।
কেস স্ট্যাডি ২ : অনার্স থার্ড ইয়ার পড়ুয়া রাজশাহীর মেয়ে তামান্না শারমিন। থাকে উওরার ৭ নম্বর সেক্টরের একটি হোস্টেলে। স্কুল, কলেজে স্যারদের কাছে পাওয়া তামান্নার ‘গুড গার্ল’ উপাধি হারিয়ে গিয়েছে হোস্টেল জীবন শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই। দিনে ‘ঘুমাই রাতে জাগি’ টাইপের একটি ফেসবুক গ্রুপেই রাত কাটে তামান্নার। টেনে-টুনে কোনভাবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার পার হওয়া তামান্না প্রায়ই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় ‘উরাধুরা পড়ালেখা করুম’/ ’পড়তে পড়তে বেহুঁশ হয়ে যাব’।
পড়ার স্ট্যাটাসের কমেন্টে পড়ালেখা নিয়ে চলে ফাজলামো, খুনসুঁটি। কোনদিন ফ্রেন্ডদের সাথে গ্রুপ চ্যাটেই, কোনদিন মোবাইলে সারারাত আড্ডা দিয়ে চলছে তামান্নার যাপিত জীবন। একটা সময় ফজরের পরপর ঘুম থেকে উঠতে অভ্যস্ত তামান্নার এখন ভোরে ঘুমিয়ে দুপুর ১টায় ঘুম থেকে ওঠা নিত্য রুটিনে পরিণত করছে। ঘণ্টায় যতবার ফেসবুক পেইজ ওপেন করে ১ মাসে ততবারও পাঠ্যবই ওপেন করেনা তামান্না।
সন্তানের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা
উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় এসে রাত জাগা নাদিয়া, তামান্নাদের সংখ্যা ১০০ কিংবা ২০০ নয়। হাজার হাজার। এবং এই সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ঢাকা শহরে হোস্টেল, মেসে থাকা ছাত্রীরা বেশীর ভাগই আসে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। লক্ষ্য, উচ্চ শিক্ষা। কিন্তু, উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে গ্রাম থেকে আসা মেয়েদের বড় একটা অংশ দূরে সরে যায় মূল লক্ষ্য থেকে।
অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। কোন রকম টেনেটুনে পাস করে শিক্ষা জীবনের ইতি টানছে। একই অবস্থা শুধু ঢাকা শহরে নয়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামের চিত্রও প্রায় একই রকম।
গ্রাম থেকে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো মা-বাবারা জানতেও পারছেনা রাত জেগে পড়ছে নাকি অনলাইনে, মোবাইল কনফারেন্সে আড্ডা দিচ্ছে আদূরের মেয়েটি। নিজে ভাল না খেয়ে, ভাল জামা-কাপড় না কিনে প্রতি মাসে মেয়ের জন্য টাকা পাঠানো মা-বাবাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয় ফাইনাল রেজাল্টের পর। সন্তানের কাছ থেকে কাক্সিক্ষত রেজাল্ট না পাওয়ার চাপা কষ্ট নীরবে হজম করতে হয়।
রাত জেগে কি করছে তামান্না, নাদিয়ারা?
ঢাকা শহরে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসা বেশীর ভাগ মেয়ে গ্রামে মা-বাবার কঠোর শাসনে বড় হয়েছে। ইন্টারমেডিয়েট পাস করার পর উড়ো উড়ো মনের সাথে ফ্যামিলি শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় এসে অবাধ স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দ। এতেই পড়ালেখা থেকে দূরে সরে মোবাইল, ইন্টারনেটে অতিরিক্ত আসক্ত হয়ে পড়ছে তামান্না- নাদিয়ারা। একটা সময় আসক্তি এমনই পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে যে, সাধারণ রিয়েল লাইফ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
বিভিন্ন হোস্টেল, মেসে থাকা ১১৫ জন ছাত্রীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন ছাত্রী হোস্টেল, মেসের বাতি বন্ধ হয় রাত ২টার পর। ৫৫ জন ছাত্রী রাত ৩টার মধ্যে, ৩৭ জন ভোরে এবং ২৩ জন রাত ২টার মধ্যে ঘুমানোর কথা জানিয়েছেন।
রাত জেগে কি করে? এমন প্রশ্নের জবাবে ৩টার মধ্যে ঘুমানো ৫৫ জন জানিয়েছেন, ক্লাস থাকলে ঘণ্টা খানেক বই নিয়ে বসা হয়। বাকি সময় স্ট্যাটাস, কমেন্ট, লাইক, চ্যাট, গ্রুফ চ্যাট কিংবা মোবাইলে কথা বলার কথা জানিয়েছেন। ভোরে ঘুমানো ৩৭ জন জানিয়েছেন ফেসবুক, হোয়াটসআ্যপ কিংবা মোবাইল ফোনে বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলা যখন যেটা ভাল লাগে তা করা। রাত ২টার মধ্যে ঘুমানো ২৩ জন জানিয়েছেন, পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা। পড়ার চাপ না থাকলে মাঝে মাঝে ফেসবুক কিংবা মোবাইলে ঘণ্টা খানেক সময় দেয়।
সর্বনাশা ফেসবুক সর্বনাশ মোবাইল কলরেটে
২০১৪ সালে আমেরিকান এডুকেশনাল রিসার্চ আ্যসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় ওহিয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক যে প্রতিবেদন সাবমিট করেছিল তাতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের খারাপ রেজাল্টের চিত্র ফুটে উঠেছিল। এরকমের খারাপ রেজাল্টের পেছনে ছিল ফেসবুকসহ জনপ্রিয় স্যোশাল সাইটগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়া।
সম্প্রতি জাপান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে স্টুডেন্টদের খারাপ রেজাল্টের পেছনে মোবাইল ডিভাইস নিয়ে সময় ক্ষেপণকেই দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের বেশীর ভাগই এখন ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসআ্যপ ব্যবহার করছে।
ফেসবুক, হোয়াটসআপ, টুইটারের পাশাপাশি বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর সস্তা কলরেটও স্টুডেন্টদের পড়ার ‘তেরটা’ বাজাচ্ছে। ছেলেদের সাথে তাল মিলিয়ে মেয়েরাও সুপার এফএনএফে ২৪ ঘণ্টা মাত্র ২৫ পয়সা, ১ টাকা ১৪ পয়সায় ১০০ এসএমএস, রাত ১২টা থেকে ফ্রি ফেসবুক ব্যবহারের পুরো সুবিধা ভোগ করছে। রাত ১২টার পর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে ফেসবুকে লগইন করার সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েছে। এবং এদের বেশীর ভাগই শিক্ষার্থী।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই
সমাজের প্রতিটি বিবেকবান মানুষ চান নাদিয়া, তামান্নারা একটি সুস্থ সুন্দর বাংলাদেশ গঠনে অবদান রাখুক, দেশকে সৎ আদর্শবান নাগরিক উপহার দেওয়ার দিকে এগিয়ে যাক। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই। রাত ১২টার পর ফ্রি ফেসবুক সেবা, সস্তা কলরেট দিয়ে যারা তামান্না, নাদিয়াদের সুন্দর আগামীর স্বপ্ন কেড়ে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিকল্প নেই বলেই সুস্থ্য বিবেকবান প্রতিটা মানুষ বিশ্বাস করে।- (শীর্ষ কাগজ)
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও জড়াচ্ছেন দেহ ব্যবসায় (ভিডিও) ক্লিক করে দেখুন
চাঁদপুর টাইমস : ডিএইচ/২০১৫।