ছাত্রজীবনেই মানুষকে মুক্তি দেয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। বামপন্থাকেই বেছে নিয়েছিলেন আদর্শ হিসেবে। নিজেকে পরিণত করেন এক তুখোড় ছাত্র নেতায়। ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি।
ভূমিকা রাখেন মুক্তিযুদ্ধেও। ১৯৭২ সাল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দেন ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগে। পরে সরকারের পরিদর্শন ও আয়-ব্যয় পরীক্ষণ অধিদপ্তরে একজন অডিটর হিসেবে কাজ করেন।
কিন্তু নিয়তি যেন তাকে ঘুরে ফিরে রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তেই রেখেছিল। জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এসএ বারী এটি। তার ব্যক্তিগত সচিব পদে মির্জা আলমগীর দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর এসএ বারী উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যান মির্জা আলমগীর।
এবার নিজ শহর ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক পদে। কিন্তু ঠাকুরগাঁও ফিরেই যেন তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতির মূলস্রোতে। ১৬ বছরের শিক্ষকতা পেশা থেকে অব্যাহতি নিয়ে ১৯৮৬ সালে অংশ নেন ঠাকুরগাঁও পৌরসভা নির্বাচনে।
জীবনের প্রথম নির্বাচনেই বিজয়ী হন তিনি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন বিএনপিতে যোগ দিয়ে ১৯৯২ সালে ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপি সভাপতি মনোনীত হন। ২০১৬ সালে এসে তিনি যখন বিএনপির মহাসচিব নির্বাচিত হন তখন ছেড়ে দেন ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতির পদ। যেন একটি চক্রের সমাপ্তি হয়।
তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রাজনীতিতে উত্থানের গল্প এতো সরল নয়। এটা অস্বীকারের জো নেই, রাজনীতিতে রয়েছে তার একটা ক্লিন ইমেজ। কথা বলেন মেপে। উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও এড়িয়ে চলেন বন্দুকের ভাষা। চারদলীয় জোট সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মির্জা আলমগীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নেই।
মূলত ভালো ইমেজের কারণেই তেমন প্রভাবশালী না হয়েও দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে মনোনীত হন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। যে মনোনয়ন ছিল দলের আগামী দিনের মহাসচিব হিসেবে প্রস্তুতির অংশ। দলের তৎকালীন মহাসচিবের মৃত্যুতে অল্প সময়ের মধ্যেই ২০১১ সালের ২০শে মার্চ তিনি দায়িত্ব পান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের। তারপর দীর্ঘ ৫ বছর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পালন করেছেন মহাসচিবের দায়িত্ব।
এ সময়ে তাকে আসামি করা হয়েছে ৮৬টি মামলায়। ৭ দফায় কারাভোগ করেছেন এক বছরের কাছাকাছি সময়। যেতে হয়েছে রিমান্ডেও। এসব ত্যাগ স্বীকারের পুরস্কার অবশ্য পেয়েছেন তিনি। নানা বিপত্তি সত্ত্বেও চলতি বছর বিএনপি চেয়ারপারসন তাকে দলের মহাসচিব হিসেবে মনোনীত করেছেন।
১৯৪৮ সালের ১লা আগস্ট ঠাকুরগাঁও জেলার এক বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জন্ম। তার পিতা অ্যাডভোকেট মির্জা রুহুল আমিন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের আমলে একাধিকবারের এমপি ও মন্ত্রী ছিলেন।
অন্যদিকে তার চাচা মির্জা গোলাম হাফিজ ছিলেন একজন খ্যাতিমান রাজনীতিক। যিনি জিয়া সরকারের ভূমিমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন। আইন-বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে।
মির্জা আলমগীরের আরেক চাচা উইং কমান্ডার এসআর মির্জা মুজিবনগর সরকারের ডাইরেক্টরেট অব ইয়ুুথ ক্যাম্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভোটের রাজনীতিতে প্রথমবার পৌর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হলেও পরাজিত হন ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে।
২০০১ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন এমপি। কেবল এমপিই নন দায়িত্ব পান কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও পরে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীর। বিএনপির ঠাকুরগাঁও জেলা সভাপতির পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি দলকে সংগঠিত করতে পারেননি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দল পুনর্গঠনে তার ভূমিকার সমালোচনা করেন অনেকে। মির্জা ফখরুল নিজে অবশ্য ব্যর্থতা মানতে রাজি নন।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আলাদীনের চেরাগ কারও হাতে নেই। যথাসময়ে সঠিকভাবে সব সাংগঠনিক কাজ সম্পন্ন করা হবে। অঙ্গ দলগুলোর বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ সেগুলো পুনর্গঠনের কথা বলা হলেও উদ্যোগ দেখা যায়নি।
কবে সে উদ্যোগ নেয়া হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেন, ‘এগুলো সবই হচ্ছে। আমাদের দল একটি সাংগঠনিক দল। এ দল প্রথম থেকেই পুনর্গঠনের ধারার মধ্যেই চলছে। এসব নিয়ে কাজ চলছে। এ কাজটি কন্টিনিউ হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধার মধ্য দিয়ে কাজ করছি। আমাদের সপ্তাহে পাঁচ দিন কোর্টে যেতে হয়।’
কোনো রাজনীতিবিদই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সঙ্গতকারণেই দলের ভেতরে-বাইরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরও কিছু সমালোচনা রয়েছে। রয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী-মিত্র। তবে এ কথা বোধ হয় বলাই যায়, ‘কালিমামুক্ত রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনি একজন।’ (মানবজমিন)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১০:০০ এএম, ৩১ আগস্ট ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ