চোর-ডাকাতের মনস্তত্ত্ব

বাংলা ভাষায় প্রাচীনকাল থেকে চোর শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রবাদ-প্রবচনে শব্দটির বহুবিধ ব্যবহার প্রমাণ বহন করে। বহুল ব্যবহৃত বাক্যাবলির মধ্যে রয়েছে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা’। ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা’। ‘চোরের মন পুলিশ-পুলিশ’। ‘চোরের সাক্ষী গাট কাটা’। ‘চোরের দশ দিন গৃহস্থের এক দিন’ ইত্যাদি। স্বপক্ষে মনস্তাত্ত্বিক যুক্তির ভিত্তিতেই চোর চুরি করে, ডাকাত ডাকাতি করে । বছর কয়েক পূর্বে ‘উত্তরা গণভবন’ পরিদর্শন করছিলাম।

সংবাদ পেয়ে নাটোরের তৎকালীন এস.পি সাহেব উপস্থিত হলেন। তিনি একজন প্রাক্তন ক্যাডেট। আমাদের সবাইকে আপ্যায়ন করার জন্য অফিসে নিয়ে গেলেন। কনফারেন্স রুমে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং-এর সময় প্রশ্নোত্তর পর্বে একটি প্রশ্ন করেছিলাম। বিভিন্ন গ্রামে বংশপরম্পরায় যারা চুরি করে আসছে, তাদের কোনো ডাটাবেইজ পুলিশের হাতে আছে কি না? আমার প্রশ্ন শুনে এস.পি সাহেব বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন, “এখনো আমরা অতটা গভীরে পৌঁছতে পারিনি, তবে প্রক্রিয়া চলছে”।

আমার প্রশ্ন শুনে দু’একজন হেসেছিলেন। অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের পাশের গ্রামে এরূপ কয়েকটি পরিবার রয়েছে। তাদের একজন পেশাদার চোরকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, চুরি করেন কেন’? সে বলল, ‘অন্যরা যেমন বাপ-দাদার পেশা জমি-জমা চাষ করে, আমরাও তেমন বাপ-দাদার পেশা চুরি করি।’ আমি বললাম, ‘আখিরাতের ভয় হয় না’? সে উত্তরে বলল, ‘যার ভাগ্যে যা লেখা আছে, সে তা-ই করে। আল্লাহ আমাদেরকে চোরের ঘরে জন্ম না দিয়ে রাজা-বাদশাহর ঘরে জন্ম দিলে অভাব থাকত না, চুরিও করতাম না।’

তার মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি শুনে উক্তি করার পূর্বে তিক্ত হলাম। আমি তাকে ভাগ্য সম্পর্কে বোঝাতে গিয়ে বললাম, ‘ভালো-মন্দ সকল কিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তা‘য়ালা হওয়ার কারণে “ভাগ্যের ভালো-মন্দ যা কিছু হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়” এরূপ বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু আপনি ভালো করবেন না মন্দ করবেন, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আল্লাহ তা‘য়ালা আপনাকে দিয়েছেন। এজন্যই তিনি মন্দ কাজের জন্য শাস্তি ও ভালো কাজের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে পুরস্কার দিবেন।’ আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তাও দেখবে।’ [আল-কুরআন, সূরা যিলযাল : ৭-৮] উপর্যুক্ত আয়াতে ‘ইয়ারহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটি ‘মুজারের সিগাহ’ যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের অর্থ প্রদান করে।

সুতরাং কর্মফল দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই পাবে। আল্লাহ তা‘য়ালা ‘আলিমুল-গাইব’ অর্থাৎ তিনি অদৃশ্যের সমস্ত কিছু জানেন। তাঁর কাছে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নাই, সবই বর্তমান। সকলের চূড়ান্ত পরিণতি তাঁর জানা। কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহ তা‘য়ালার পথে চলার ইচ্ছা পোষণ করেন, তিনি তাকে সাহায্য করেন। তার পথকে সহজ করে দেন। কেনো ব্যক্তি যদি অসৎ পথে পরিচালিত হয়, আল্লাহ তাকে দুনিয়ার জীবনের জন্য অবকাশ দেন।

মুনাফিকদের ভণ্ডামির একটি উদাহরণ উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন, ‘যখন তারা মু’মিনগণের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’; আর যখন তারা নিভৃতে শয়তানদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে, ‘আমরা তো তোমাদের সঙ্গেই রয়েছি; আমরা শুধু তাদের সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি।’ আল্লাহ তাদের সঙ্গে তামাশা করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবার অবকাশ দেন।’ এরা হিদায়াতের বিনিময়ে ভ্রান্তি ক্রয় করেছে। সুতরাং তাদের ব্যবসা লাভজনক হয় নাই, তারা সৎ পথে পরিচালিত নয়।’ [আল-কুরআন, সূরা বাকারা : ১৪-১৬] আয়াতের ভাষ্য থেকে বোঝা যায় যে, ব্যক্তি সৎ পথে পরিচালিত হওয়ার ইচ্ছা করলে আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে সাহায্য করেন বটে কিন্তু ভালো পথে আসতে বাধ্য করেন না। অনুরূপভাবে অসৎ পথে পরিচালিত হলে তাকেও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবকাশ দেন। সুতরাং আপনি সৎভাবে জীবনযাপন করলে আপনার জন্যই ভালো হবে। পরিশেষে জীবনে আর চুরি না করার ব্যাপারে সে আমার নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

একজন সরকারি চাকুরের যুক্তি শুনে অবাক হলাম। তিনি নিজের ঘুষ গ্রহণের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে স্বল্প বেতনের কথা উল্লেখ করলেন। চা-স্টলে বিষয়টির পক্ষে-বিপক্ষে তর্কযুদ্ধ শুরু হলো। আমি বললাম, মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি কোনো কাজে লিপ্ত হয় না ঠিক, তবে সব ক্ষেত্রে যুক্তিবাদী না হওয়াই ভালো। কোনো ব্যক্তি যদি হারাম কোনো বস্তুকে হারাম মনে করে গ্রহণ করে, তবে তার কবিরা (মারাত্মক/বড়) গুনাহ হবে। কিন্তু যদি হারাম বস্তুকে হালাল মনে করে গ্রহণ করে, তবে পরিণতি হবে অধিক ভয়াবহ। একজন অবাক হয়ে বললেন, কী হবে? আমি বললাম, ‘কুফর’। কাফিরের জন্য সৎ কাজের পুরস্কার দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হবে, আখিরাতে সরাসরি জাহান্নাম। অন্যায়কারী দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত হয় ও মানুষের ঘৃণা নিয়ে বিদায় নেয়। বাহ্যিকভাবে শান্তি লাভের সম্ভাবনা দেখা দিলেও প্রকৃত শান্তি অধরাই থেকে যায়। অন্যায়কারীর নিজের দ্বারা অথবা তার পরবর্তী প্রজন্মের দ্বারা প্রমাণিত হয় কৃত অন্যায়ের নিষ্ফল প্রতিদান। এরূপ বহু ঘটনা মানবসমাজে প্রমাণিত হয়েছে। সত্যই চূড়ান্তভাবে জয়লাভ করে। সত্যই টিকে থাকে, মিথ্যা প্রমাণিত হয় ও পরাজিত হয় সময়ের করাঘাতে।

এবার ডাকাতের মনস্তত্ত্বের ব্যাপারে আসা যাক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। তিনি হয়তো বা ছন্দ মিলাতে গিয়ে “দুই বিঘা জমি” কবিতায় ডাকাতের স্থলে চুরি শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যে কাহিনী তিনি উল্লেখ করেছেন তা মূলত ডাকাতির ঘটনা। প্রকাশ্য দিবালোকে লাঠি-শোটা নিয়ে জোর করে একটি পরিবারকে বিনা দোষে উচ্ছেদ করাকে ডাকাতিই বলতে হবে। এ হলো বৃটিশ আমলে ডাকাতির একটি চিত্র। ইতিহাসে এরূপ অজস্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। বিজয়ের মাসে আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে পাকিস্তানিদের কৃত অপকর্মের একটি ফিরিস্তি প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপিত হলো। মুহাম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার ফলে সম্ভবত পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিজেদের পূর্ব পাকিস্তানিদের চেয়ে উত্তম মনে করত। এ ধারণা সত্য হলে নিঃসন্দেহে তা ছিল ভ্রান্ত মনস্তত্ত্বের ফসল।

পশ্চিমারা সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের ঠকিয়েছে। বৈষম্যের ফিরিস্তি লিখলে সহস্র পৃষ্ঠায়ও ধরবে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বার বার নির্বাচিত হয়েও পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতায় বসতে পারেননি। নানা ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের টালবাহানার দোলাচলে বাঙালিরা ক্ষমতায় বসতে পারেননি। বার বার গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য নেতৃবৃন্দকে নানা প্রকার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। করতে হয়েছে নয় মাসের ভয়াবহ মুক্তি যুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানিরা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে বাঙালিরাই পাকিস্তানের চালকের আসনে থাকার কথা। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পকিস্তানের চেয়ে অধিক ছিল। মুক্তির জন্য সংগ্রাম করলে করতে হতো পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই। হয়তো বা বাংলার মানুষের মমত্ববোধের শীতল ছায়ায় সিক্ত হয়ে সাম্য-মৈত্রীর এক অমর মেলবন্ধনে আবদ্ধ থাকতেও পারতো।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভ্রান্ত মনস্তত্ত্ব তাদের অধিক লোভী ও জালিমে পরিণত করেছিল। যার ফলে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা। লাখো শহীদের রক্ত নদী পেরিয়ে হলেও বিজয় এসেছে মজলুম বাঙালির ঘরে। পরাজিত হয়েছে অত্যাচারী, দাম্ভিক, ক্ষমতালোভী, অগণতান্ত্রিক পশ্চিম পাকিস্তানি অপশক্তি । পরাজিত হয়েছে চোর-ডাকাতের মনস্তত্ত্ব।

লেখক : ড. এম এ মতিন, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ

|| আপডেট: ০৫:৩১ পিএম, ২২ ডিসেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার

এমআরআর  

Share