বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য আরো দুই হাজার কোটি টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। গতকাল সোমবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ নিয়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল। এর মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘প্রতিকার পরিকল্পনা’ তহবিলের পাঁচ-ষষ্ঠাংশ অজির্ত হলো। সংকট শুরুর পর প্রথম ছয় মাসের জন্য এই তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কুয়েতের আহ্বান ও সহযোগিতায় আয়োজিত এই সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিদিন হাজারো রোহিঙ্গা পালিয়ে আসায় ‘অগ্রহণযোগ্য’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গত রবিবার বাংলাদেশে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছয় লাখ অতিক্রম করেছে।
গতকাল ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জেনেভা সম্মেলনে পাওয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতির কথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে জেনেভায় আয়োজিত এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবিক সহায়তার ব্যাপারে একতাবদ্ধ হয়েছে। তারা জরুরি মানবিক সংকট মোকাবেলায় মোট ৩৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (দুই হাজার ৮১৬ কোটি পাঁচ লাখ বাংলাদেশি টাকা) সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সম্মেলনে গতকাল অর্জিত হয়েছে আরো ২৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (এক হাজার ৯৩৮ কেটি ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা)।
জাতিসংঘের ঢাকা অফিস আরো জানায়, অক্টোবরের শুরুতে বাংলাদেশে কর্মরত মানবিক সংস্থাগুলো ৪৩৪ মিলিয়ন ডলারের (তিন হাজার ৫৯৪ কোটি, ৬০ লাখ ৫০ হাজার টাকা) একটি ‘প্রতিকার পরিকল্পনা’ (রেসপন্স প্ল্যান) ঘোষণা করে। তখন থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত আছে। এখনো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্তের দিকে আসছে, যা প্রতি সপ্তাহেই ঘটছে।
এই প্রতিশ্রুতি সম্মেলনের আগে প্রতিকার পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ শতাংশ তহবিল অর্জিত হয়েছিল। সোমবার সম্মেলনে নতুন করে তহবিল বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের জীবনরক্ষাকারী সহায়তা কার্যক্রম সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ডি উইটকিনস বলেন, ‘এটি এই মুহূর্তের বিশ্বের দ্রুততম অবনতিশীল শরণার্থী সংকট। তাই আমাদের মানবিক কার্যক্রমের গতি বাড়াতে আরো তহবিলের জন্য জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। সীমান্ত খোলা রাখায় আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা বাংলাদেশের মানুষের প্রতিও কৃতজ্ঞ। তারা নতুন করে আসা ব্যক্তিদের সহায়তায় আন্তরিক। এই শরণার্থীদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। শরণার্থীদের সহায়তায় অতি জরুরি প্রয়োজনে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এগিয়ে এসেছে। ’
রবার্ট উইটকিনস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আজ আরো ২৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিরিক্ত সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে সংকট মোকাবেলায় ৩৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল। এই সুবাদে এখন সহায়তা সংস্থাগুলো জীবনরক্ষাকারী কার্যক্রমকে অর্থাৎ আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র, পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুরক্ষা সেবা দিয়ে যেতে পারবে এবং আরো সম্ভাব্য কোনো সংকট মোকাবেলা করতে পারবে। ’
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, প্রথম ছয় মাসের জন্য এই সহায়তা তহবিল সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সম্ভাব্য মানবিক কার্যক্রমের বিপরীতে এই তহবিল খরচ হবে। গতকালের সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তিন কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া তুরস্ক পাঁচ কোটি, কুয়েত দেড় কোটি ডলার, যুক্তরাজ্য ১২ মিলিয়ন পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়া ১০ মিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার ও ডেনমার্ক ১০ মিলিয়ন ডলার দেবে। এই তহবিলের সুবিধা পাবে ৯ লাখ রোহিঙ্গা ও তিন লাখ স্থানীয় মানুষ, যারা কক্সবাজারে মিয়ানমার সীমান্তে বসবাস করছে।
রয়টার্স জানায়, সম্মেলনে অংশ নিয়ে জেনেভায় জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের দূত শামীম আহসান বলেছেন, মিয়ানমারের সহিংসতায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা একটি ‘অগ্রহণযোগ্য’ পরিস্থিতি। তিনি এসব মানুষকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার পর কোনো একটি দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা এটি। তিনি বলেন, দেশটি দাবি করলেও রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ হয়নি। এখনো প্রতিদিন হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।
শামীম আহসান আরো বলেন, “কিন্তু রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে তাদের ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী’ হিসেবে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমার। এই জাতিগত পরিচয় অস্বীকার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রতিবন্ধকতা হয়েই থাকবে। ”
ব্র্যাকের অঙ্গীকার : এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক জানায়, জেনেভায় অনুষ্ঠিত গতকালের এই সম্মলনে ব্র্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ডা. মুহাম্মাদ মুসা অংশ নিয়েছেন। বৈঠকে তিনি ব্র্যাকের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব রকম সহায়তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে একমাত্র ব্র্যাকই এই বৈঠকে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে। বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণ সমন্বয়ক ও মানবিক কার্যক্রমবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোকক।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ 2:০৩ এএম, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭ মঙ্গলবার
ডিএইচ