ডিসি অফিসে উমেদারগিরি ও জমির দালালি করেই তিনি এখন কোটিপতি। যিনি একসময় ফেরি করে চা বিক্রি করতেন। সৌভাগ্যবান এ ব্যক্তির নাম জসিম উদ্দিন।
কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, গাড়ি-বাড়ি সবই হয়েছে তার। এখন তিনি কাজে আরও গতি আনতে রাজধানীর হাটখোলা রোডে রীতিমতো অফিস খুলে বসেছেন। কিন্তু বাস্তবে এ রকম জসিম উদ্দিন একজন নন, ঢাকা ডিসি অফিসে তার কাতারে রয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা হওয়া ভুক্তভোগীদের একাধিক লিখিত অভিযোগ থেকে এমন চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে ঢাকা ডিসি অফিসের উমেদার নামধারী জমির দালাল ছাড়াও এ কাজে সার্ভেয়াররাও কম যান না। একাধিক সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুদক, জেলা প্রশাসক এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দফতরে।
গত কয়েক মাসে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অন্তত ১৮ জন সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি অনিয়মের অকাট্য প্রমাণসহ একাধিক লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে সরকারি অধিগ্রহণকৃত জমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ লোপাটসহ নানা গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া জমি সংক্রান্ত নানা কাজে দৈনন্দিন হয়রানি ও ফাইল আটকে ঘুষ আদায়ের মতো ওপেন সিক্রেট অভিযোগ জমা পড়েছে অসংখ্য। এসব অভিযোগের কয়েকটিতে সার্ভেয়ারদের দুর্নীতির প্রধান সহযোগী হিসেবে কয়েকজন প্রভাবশালী উমেদার বা দালালের নামও উল্লেখ করা হয়।
প্রসঙ্গত গত জুলাইয়ে ঢাকা ডিসি অফিসের ৬ সার্ভেয়ারসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয় দুদক। সরকারি অর্থ লোপাটের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়।
দুদকের মামলার পর ডিসি অফিসের ভূমি শাখায় জনহয়রানি ও দুর্নীতি কিছুটা কমলেও এখন ফের আগের অবস্থা ফিরে এসেছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, ৬ জন সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করার পর তাদের সবাইকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে বরখাস্ত আদেশের ওপর তারা স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে।
তবে সার্ভেয়ারদের দুর্নীতির বিষয়ে যখনই কোনো সুর্নিদিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে তখনই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অল্প কিছুদিন আগেই একজন সার্ভেয়ারকে ধামরাইয়ে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারিভাবে উমেদার বলে কোনো পদ নেই। তবে দেশের সব ডিসি অফিসেই কিছু লোক স্বপ্রণোদিত হয়ে বিনা পারিশ্রমিকে ভূমি সংক্রান্ত সরকারি কাজে সহায়তা দেন।
ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত ও আইটি শাখায় এরকম ৭ জন আছেন। এর বাইরে কেউ আছে কিনা তা তার জানা নেই।
তবে এদের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে তাৎক্ষণিক বহিষ্কার করা হবে। শুধু উমেদার নয় ডিসি অফিসে দুর্নীতি করলে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঢাকা ডিসি অফিসের সার্ভেয়ার আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ জমা পড়ে।
এসব অভিযোগে বলা হয়, দুর্নীতিবাজ কয়েকজন সার্ভেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অর্থ ছাড় প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। ভুয়া ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক সাজিয়ে সরকারি অর্থ লোপাটে তারা সিদ্ধহস্ত।
দীর্ঘদিন ধরেই তারা এ ধরনের দুর্নীতি করে আসছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, সার্ভেয়ার আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২৪ আগস্ট রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় তিনটি মামলা করে দুদক। এরপরও তাদের দুর্নীতি থেমে নেই। বরং তারা আগের থেকেও বেপরোয়া।
দুদক সূত্র জানায়, বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২৪ আগস্ট আবুল কালাম আজাদসহ ৫ সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এই আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় আরও ৫ জন সার্ভেয়ার যথাক্রমে মজিবুর রহমান, আবু জাফর, আফজাল হোসেন, মনিরুজ্জামান ও নাঈম আহমেদ জড়িত।
এদের সবাইকে আসামি করে গত ৬ জুলাই চার্জশিট দেয় দুদক। দুদকের এ সংক্রান্ত চার্জশিটে বলা হয়, ‘ভুয়া রেকর্ড তৈরি করে একজনকে ক্ষতিগ্রস্ত মালিক সাজিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের ৩৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
২০১১ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এলএ শাখায় (এলএ কেস নথি নং ২/২০০৭-০৮) এ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। সরকারের অধিগ্রহণ করা খিলক্ষেত মৌজার ৮৯৬নং দাগে শূন্য দশমিক ৭০ একর জমির ভুয়া মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি করেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সার্ভেয়ার।
ভুয়া রেকর্ডপত্রকে প্রকৃত রেকর্ড উল্লেখ করে নূর নাহার নামে একজন মহিলাকে ভুয়া ক্ষতিগ্রস্ত মালিক সাজানো হয়। এরপর তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নামে সরকারি কোষাগার থেকে ৩৮ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার।’
৬ সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার পরও সার্ভেয়ারদের দুর্নীতি থেমে নেই। আনিস নামের জনৈক প্রভাবশালী সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। গত মাসে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর রেজিস্ট্রি ডাকযোগে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাঠান রাজধানীর খিলক্ষেতের মস্তুল এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান।
এতে বলা হয়, মস্তুল মৌজায় সরকারি অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে অনেকটা জিম্মি দশার শিকার। সার্ভেয়ার আনিসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে স্থানীয় কিছু দালাল। তারা ক্ষতিপূরণের অর্থ ছাড় প্রক্রিয়ায় জমির প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের রীতিমতো জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আনিস নামে জনৈক সার্ভেয়ার এলএ শাখায় বদলি হওয়ার আগে ভিপি শাখায় কর্মরত ছিল।
তার বিরুদ্ধে পুরান ঢাকার অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত নথি গায়েবের অভিযোগ উঠলে ভিপি শাখা থেকে তাকে এলএ শাখায় বদলি করা হয়। কিন্তু এলএ শাখাতেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, আনিস ভিপি শাখায় কর্মরত থাকার সময় অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত চারটি হিন্দু বাড়ির নথি গায়েব হয়ে যায় (ভিপি কেস নং ২৩৪ ও ২৩৫ নবাবপুর রোড এবং ৫০ নভেন্দ্র চন্দ্র বসাকলেন ও ১২/১ বংশালসহ অন্যান্য)। নথি উপস্থাপন করতে না পারায় এ সংক্রান্ত মামলায় সরকারপক্ষ হেরে যায়।
এর ফলে সরকারের প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়।
সার্ভেয়ারের পাশাপাশি একাধিক উমেদারের বিরুদ্ধেও মোটা অঙ্কের ঘুষ বাণিজ্যের সচিত্র অভিযোগ জমা পড়েছে। এ সংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি অভিযোগে বলা হয়, সার্ভেয়ারদের দুর্নীতির প্রধান সহযোগী উমেদার নামের দালালরা। তারাই মূলত জমিজমার বিভিন্ন ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছেন।
পরে সার্ভেয়ারদের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নামে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করেন তারা। এসব উমেদারের অনেকে আবার নিজেদের প্রভাবশালী বলেও পরিচয় দেন। এর ফলে সাধারণ মানুষ ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হলেও ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চায় না।
সূত্র জানায়, কোতোয়ালি এসি ল্যান্ড অফিসে জনৈক জসিম উদ্দীন নিজেকে উমেদার বলে পরিচয় দেন। বর্তমানে নামজারির উমেদারি ছাড়াও তিনি এলএ শাখায় জমির দালালি করেন।
রাজধানীর ২৬ হাটখোলা রোডের দেলোয়ার কমপ্লেক্সে এবং ৮/১ ওয়ারী হেয়ার স্ট্রিটে রীতিমতো অফিস খুলে তিনি জমির দালালি করেন। উমেদার ও দালালি করে তিনি এখন কোটিপতি। অথচ আগে তিনি ঢাকার আদালত পাড়ায় ফেরি করে চা বিক্রি করতেন।
সূত্র জানায়, ঢাকা ডিসি অফিসের এলএ শাখায় এ ধরনের উমেদারের সংখ্যা একেবারে কম নয়। জনৈক উমেদার শাহ আলম, আবদুল হান্নান, সিএস আক্কাস, আবদুল মতিন ও মুজিবুর রহমান জমি সংক্রান্ত সব কাজের কাজী। এর মধ্যে আক্কাস ওরফে সিএস আক্কাস একনামে ডিসি অফিসে পরিচিত। কারণ ব্রিটিশ আমলের সিএস পর্চা জালিয়াতির ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত আক্কাসের সমকক্ষ ডিসি অফিসে আর কেউ নেই।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে সার্ভেয়ার আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন প্রকৃতপক্ষে দুদকের মামলাটি হয়রানিমূলকভাবে করা হয়েছে।
অর্থ আত্মসাতের মতো নিকৃষ্ট কাজের সঙ্গে তারা কোনোভাবেই জড়িত নন। তাছাড়া ভুল ব্যক্তিকে অর্থ পরিশোধের (মিস পেমেন্ট) ঘটনায় টাকা উদ্ধারের জন্য জেলা প্রশাসনের মামলা চলমান।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুদকের মামলার পর পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন।(জুগান্তর)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১ :০০ পিএম, ১৬ অক্টোবর, ২০১৭ সোমবার
এইউ