জাতীয়

চালের কেজি মিলের চেয়ে ১৮ টাকা বেশি বিক্রি

করোনাকালে চালের দাম বাড়ায় দুশ্চিন্তায় মানুষ
ঢাকায় চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে আড়তদারদের সিন্ডিকেট
অভিযান চালানো হলে কমবে চালের দাম

দেশে চালের রাজ্য বলে পরিচিত কুষ্টিয়া, শেরপুর, নওগাঁ ও দিনাজপুর। সেখানে এখন পর্যন্ত চালের দাম বাড়েনি। এক সপ্তাহ আগে যা ছিল এখনো সেই দামই রয়ে গেছে। অথচ মিলে চালের দাম বেড়ে গেছে দাবি করে ঢাকায় তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন আড়তদাররা। আসন্ন রমজানকে ঘিরে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় এভাবে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীসহ নিম্নআয়ের মানুষ। করোনাভাইরাসের কারণে আয়-রোজগারে যে ধাক্কা পড়েছে, সেটা সামলাতেই হিমশিম খাওয়া মানুষ রোজায় কী করবে, সেই দুর্ভাবনায় চোখে এক প্রকার অন্ধকার দেখছে।

আজ শনিবার (১৮ এপ্রিল) কুষ্টিয়া, শেরপুর, নওগাঁ ও দিনাজপুর এলাকায় চালের দাম যাচাই করে দেখা গেছে, ঢাকার সঙ্গে প্রকারভেদে চালের দামের পার্থক্য কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৮ টাকা পর্যন্ত। মিল মালিকরা বলছেন, ঢাকায় চালের দাম এতো বাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। ঢাকার আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন। যদিও ঢাকার ব্যবসায়ীদের দাবি, গাড়ি ভাড়া বেশি বলে চালের দামও বেড়ে গেছে।

রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মিনিকেট ও নাজিরশাল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৮ টাকা কেজি। মাঝারি মানের পইজাম ও কাজল লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৬০ টাকা। আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৫০ টাকা।

টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) তথ্য অনুযায়ী, ১৫ এপ্রিল রাজধানীর খুচরা বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাল চালের কেজি বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৬৮ টাকা। মাঝারি মানের চালের কেজি বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৮ টাকা। আর মোটা চাল বিক্রি হয় ৪২ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে।

কুষ্টিয়া, শেরপুর, নওগাঁ ও দিনাজপুরের চাল ব্যবসায়ী, চাতাল মালিকদের দামের সঙ্গে ঢাকার চালের দাম তুলনা করলে দেখা যায়, ব্যবধান অনেক। কেজিপ্রতি চালের ব্যবধান আসে ১২ টাকা থেকে ১৮ টাকা।

কুষ্টিয়া জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন সেখানকার চালের বাজারদর প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের এখানে রশিদের মিনিকেট যেটা সবচেয়ে ভালো, এর ওপর বাংলাদেশে কোনো মিনিকেট নেই, সেটা বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা কেজি। অন্য মিলের মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫১ টাকা কেজি। মাঝারি মানের চাল কাজল লতা, পাইজাম ও আটাশ ধানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা। আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা দরে।

এসব চালের ঢাকার দাম জানিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়নাল আবেদীন বলেন, ঢাকায় চালের দাম কেন বেশি এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে দেশের উত্তরাঞ্চলের মিলগুলোতেও চালের দাম বাড়েনি।

কুষ্টিয়া, শেরপুর, নওগাঁ ও দিনাজপুরের চালের দাম তুলনা করে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় একই দাম। তবে ওইসব এলাকার দামের সঙ্গে ঢাকার দামের তুলনা করে দেখা যায়, কুষ্টিয়ার রশিদের মিনিকেট ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকা কেজি। অর্থাৎ কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় এক কেজি চালের দামের পার্থক্য ১৬ টাকা। মাঝারি মানের পইজাম ও কাজল লতা এবং আটাশ ধানের চাল ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৬০ টাকা। এই চালের দামে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১৮ টাকা পর্যন্ত। ঢাকায় মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। মিলের দামের সঙ্গে ঢাকার দামের পার্থক্য দাঁড়াচ্ছে ১২ টাকা।

ঢাকায় চালের দাম বাড়া প্রসঙ্গে দিনাজপুরের চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিদুর রহমান পাটোয়ারি মহন বলেন, ঢাকার আড়তদারদের কাছে যে পরিমাণ চাল আছে তাতে চালের দাম বাড়ার কথা নয়, সংকটও হওয়ার কথা নয়। আমি নিশ্চিত তারা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাদের এখানে সাতদিন আগে চালের দাম যা ছিল, এখনো তাই আছে।

ঢাকার বাবু বাজার, সায়েদাবাদসহ বিভিন্ন বাজারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক একজন মালিকের গুদামে ৪-৫ হাজার বস্তা চাল আছে। তাহলে চালের কী সংকট আছে যে চালের দাম বাড়বে? র‌্যাব বা পুলিশ যখন অভিযান চালাবে তখন দেখা যাবে মিল রেটের সঙ্গে তাদের বিক্রির রেট অনেক হাই। এটা তো হওয়ার কথা নয়। লাভের তো একটা লিমিট থাকবে। ঢাকার আড়তদাররা যে পরিমাণ চাল মজুদ রাখে তা রাখার কথা নয়। কারণ সারাদেশে যথেষ্ট চাল এখনো আছে।

শেরপুর চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হামিদ বলেন, চালের দাম বাড়ার তো প্রশ্নই উঠে না। বরং কেজিতে আরও এক টাকা কমে গেছে। বাজারে আগাম জাতের কিছু নতুন ধান আসায় ধানের দাম ও চালের দাম দুটোই কিছুটা কম।

ঢাকার ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচের দাবি প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঢাকার ট্রাক ভাড়া এখন অনেক বেশি। সে কারণে হয়তো চালের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু কেজিতে ১০-১২ টাকা কখনোই বাড়া উচিৎ নয়। যারা এটা করছে তাদের প্রশাসনের ধরা উচিত।

ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম বেড়ে যায়। এরপর র‌্যাব একের পর এক অভিযান পরিচালনা করলে কিছুটা থিতু হয় চালের দাম। প্রায় এক মাস চালের দাম স্থির থাকে। তবে এক সপ্তাহ ধরে আবার চালের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।

খুচরা ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত চিকন চালের দাম আগে বাড়ে। তারপর বাড়ে মোটা চালের দাম। তবে এবার আগে মোটা চালের দাম বেড়েছে। তারপর বেড়েছে চিকন চালের দাম।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের কারণে কষ্টে থাকা গরিব মানুষের পাশে অনেকে দাঁড়াচ্ছেন। তারা গরিব মানুষকে ত্রাণ হিসেবে মোটা চাল দিচ্ছেন। এ কারণে মোটা চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়িয়েছে অসাধু চক্র। এখন নতুন করে চিকন ও মাঝারি চালের দাম বাড়ছে। এর কারণ হতে পারে করোনার শুরুতে যারা চাল কিনেছিলেন তাদের অনেকের চাল শেষ হয়ে গেছে। এখন তারা আবার খাওয়ার চাল কিনছেন। এতে চাহিদা বেড়েছে। এর ফলেই বেড়ে গেছে দাম।

খিলগাঁও তালতলা থেকে চাল কেনা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের পরিবারের চারজন সদস্য। মার্চের শুরুতে ২৫ কেজির এক বস্তা চাল কিনেছিলাম। সেই চাল শেষ হয়ে গেছে। তাই আজ চাল কিনতে এসেছি। আগে যে চালের বস্তা ১৩০০ টাকায় কিনেছি, এখন সেই চাল ১৬০০ টাকা চাচ্ছে। ২৫ কেজি চালের দাম এক মাসে ৩০০ টাকা বেড়ে গেছে। এটা কিভাবে স্বাভাবিক হয়? এদিকে করোনা আতঙ্ক কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, অন্যদিকে পণ্যের দাম ভোগাচ্ছে।

খিলগাঁওয়ের চাল ব্যবসায়ী মো. জানে আলম ভূঁইয়া বলেন, ত্রাণ দিতে অনেকে মোটা চাল কিনছেন। এ কারণে বাজারে মোটা চালের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গত সপ্তাহেই দাম বেড়ে গেছে। তবে গত সপ্তাহে চিকন চালের দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন আবার বেড়েছে। পাইকারিতে সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম কেজিতে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এ কারণে আমরা বাড়তি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ধারণা, পাইকারি বাজারে অভিযান চালালে চালের দাম কমে যেতে পারে। এর আগে র‌্যাব অভিযান চালানোর কারণে কয়েক সপ্তাহ চিকন চালের দাম স্থির ছিল। কিন্তু এখন র‌্যাবের অভিযান না থাকায় আবার নতুন করে দাম বাড়ছে।

ঢাকা ব্যুরো চীফ,১৯ এপ্রিল ২০২০

Share