প্রেমের টানে ঘর ছেড়েছিলেন নীলফামারীর লিপা রানী রায় (২০) ও হুমায়ুন ফরিদ লাজু (২৩)। হিন্দু থেকে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে হোসনে আরা লাইজু নামও নিয়েছিলেন
উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী শুক্রবার (৪ মে) বিকেল তিনটায় নীলফামারী জেলা প্রশাসকের নিয়োগকৃত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
এর আগে একই উপজেলার পূর্ব বোড়াগাড়ী কাজীপাড়া জামে মসজিদ চত্বরে দুই দফা নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজায় প্রায় ১০ হাজারের বেশি মুসল্লি অংশ নিতে আসায় জায়গার অভাবে দুই দফায় জানাজা করা হয়। প্রথম জানাজার ইমামতি করেন মেয়েটির দাদা শ্বশুর ওই জামে মসজিদের সাবেক ইমাম মওলানা কাজী আব্দুল জলিল ও দ্বিতীয় জানাজার ইমামতি করেন একই জামে মসজিদের বর্তমান ইমাম মওলানা রবিউল ইসলাম।
লাশের দাবিতে মেয়ের বাবা ও শ্বশুরের মধ্যে চলা আলোচিত এই মামলার নথি থেকে জানা যায়, নীলফামারীর ডোমার উপজেলার অক্ষয় কুমার রায় মাস্টারের মেয়ে লিপা রাণী’র সাথে একই উপজেলার জহুরুল ইসলামের ছেলে হুমায়ূন ফরিদ লাজুর প্রেমের সম্পর্ক ছিল।
একপর্যায়ে ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর লিপা রাণী লাজুর সাথে পালিয়ে যায়। ধর্মান্তরিত হয়ে লাজুকে বিয়ে করে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে লিপা রাণী রায় তার নাম রাখেন মোছা. হোসনে আরা ওরফে লাইজু।
এরপর লিপার বাবা ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর বাদি হয়ে নীলফামারী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে একটি অপহরণ মামলা করেন। কিন্তু মেয়ে ও ছেলে তাদের স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ের সকল কাগজপত্রসহ আদালতে হাজির করে জবানবন্দি দিলে আদালত অপহরণ মামলাটি খারিজ করে দেন।
কিন্তু মেয়ের বাবা মামলার খারিজের বিরুদ্ধে আপিল করে তার মেয়েকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও মস্তিষ্ক বিকৃত দাবি করেন। পরবর্তীতে আদালত সে আবেদন আমলে নিয়ে মেয়েটিকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য রাজশাহীর সেফ হোমে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মেয়েটি সেফ হোমে থাকা অবস্থায় ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি তার স্বামী হুমায়ূন ফরিদ লাজু ( বিষক্রিয়ায় অথবা বিষপানে ) মারা যান।
লাজুর মারা যাওয়ার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করে মেয়ের বাবা তার মেয়েকে নিজ জিম্মায় নিতে আদালতে আবেদন করে ২০১৪ সালের ১৬ জানুয়ারি মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে রাখেন।
এরপর ২০১৪ সালের ১০ মার্চ বাবার বাড়িতে নিজ শোবার ঘরে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করে মেয়েটি। আর ২০১৪ সালের ১১ মার্চ মেয়েটির মরদেহ ময়না তদন্ত করা হয়।
এরপর পুত্রবধূ দাবি করে মেয়েটির শ্বশুর জহুরুল ইসলাম- ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক দাফনের জন্য আদালতে আবেদন করেন।
তবে মেয়ের বাবা অক্ষয় কুমার হিন্দু শাস্ত্র মতে সৎকারের জন্য আদালতে আবেদন করেন।
এরপর উভয়পক্ষের শুনানি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ডোমার থানা পুলিশকে একটি প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। কিন্তু উভয়পক্ষ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে ডোমার থানা পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করলে আদালত মেয়েটির মরদেহ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংরক্ষণের আদেশ দেন। এরপর মেয়েটির মরদেহ মর্গেই রাখা হয়।
পরবর্তীতে মেয়েটির মরদেহ দাবির মামলা মেয়েটির শ্বশুরের পক্ষে গেলে তার বিরুদ্ধে মেয়ের বাবা জেলা-জজ আদালতে আপিল করেন। আপিলে মেয়ের বাবার পক্ষে রায় আসে।
এরপরই মেয়েটির শ্বশুর জহুরুল ইসলাম ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। সে আপিলের শুনানি নিয়ে গত ১২ এপ্রিল বিচারপতি মিফতা উদ্দিন চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ ধর্মান্তরিত হওয়া হোসনে আরা’র মরদেহ তার শ্বশুরের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়ে ওই মরদেহ ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক দাফনের রায় দেন। এবং দাফনের সময় একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও প্রয়োজনীয় পুলিশ ফোর্স রাখার জন্য নীলফামারীর ডিসি’র প্রতি রায়ে নির্দেশ দেওয়া হয়। আর দাফনের আগে শেষবারের মত মেয়ের বাবা ও তার পরিবারকে মরদেহ দেখার সুযোগ দিতে রায়ে বলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টে শ্বশুরের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোঃ সাফিউর রহমান। আর মেয়ের বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী।
শুক্রবার লাজুর ভাই হুমায়ুন রশিদ জানান, হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী শুক্রবার দুপুরে মর্গ থেকে হোসনে আরা’র মরদেহ আনা হয় (শ্বশুর বাড়ী) আমাদের বাড়িতে। এসময় এখানে উপস্থিত থাকে ম্যাজিস্ট্রেট সহ স্থানীয় বিপুল সংখ্যক পুলিশ। দুপুর সাড়ে তিনটায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর চারটায় আমার ভাই লাজুর কবরের পাশেই দাফন করা হয় হোসনে আরা কে।
হুমায়ুন রশিদ আরো জানান, মেয়ের বাবা এবং পরিবারকে আগেই জানান হয়েছিল শুক্রবার লাশ দাফন হবে। তবে তারা কেউ শেষ বারের জন্যেও লাশ দেখতে আসেনি।
চ্যানেল আই