বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় ‘চা’। ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা ক্লান্তি দূর করে শরীর-মনে এনে দেয় চনমনে অনুভূতি। আমাদের দেশে চা শুধু পানীয় নয়। বরং চা শিল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে কারণেই বিশ্ব চা দিবসের বাইরেও আলাদা করে জাতীয় চা দিবস পালিত হচ্ছে দেশজুড়ে। এ বছর তৃতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে জাতীয় এ দিবসটি। চায়ের পুষ্টিগুণ এবং কখন কীভাবে চা পান করবেন, সে বিষয়ে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ
চা পাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন, পটাশিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফলমূল বা শাকসবজির চেয়েও বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে চা পাতায়। তবে চায়ের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পূর্ণ মাত্রায় পেতে চাইলে চুলায় চা ফোটানো যাবে না। গরম পানিতে চা পাতা বা টি ব্যাগ বেশ খানিকক্ষণ ভিজিয়ে রেখে পান করতে হবে। চা পাতায় রয়েছে ক্যাফেইন নামক উত্তেজক পদার্থ। সাধারণত এক কাপ চায়ে প্রায় ৩০-৪০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। ক্যাফেইনের ভালো দিক হলো এটি হৃৎপিণ্ড ও পেশি সতেজ রাখতে সহায়তা করে। তবে ক্যাফেইনের কারণেই ঘুম কম হওয়া, হজমে ব্যাঘাত ঘটা ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া ঘুমের সমস্যা থাকলে সন্ধ্যার পর চা পান করা উচিত নয়। উপকারিতার পাশাপাশি চায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকিও কিন্তু কম নয়। অতিরিক্ত চা পান করা একেবারেই উচিত নয়। দিনে এক থেকে দুই কাপ চা যথেষ্ট। আমাদের দেশে বেশ কয়েক ধরনের চা প্রচলিত। এর মধ্যে দুধ চা, রং চা, গ্রিন টি ও ওলং টি উল্লেখযোগ্য। সব চায়ের রয়েছে আলাদা আলাদা খাদ্যগুণ।
রং চা : রং চা ব্ল্যাক টিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। সকালে নাশতার দুই ঘণ্টা পর নিয়মিত রং চা পান করলে হৃদরোগ, ভাইরাল জ্বর ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। রং চায়ের সঙ্গে এলাচ, দারুচিনি, লং ও আদা মিশিয়ে নিলে চায়ের স্বাদ যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি ভেষজ গুণও বেগে যায় বহুগুণ। হজমশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট প্রতিকার করে। আদা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মাথাব্যথা, সর্দি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আদা চা পান করলে স্বস্তি পাওয়া যায়।
গ্রিন টি : স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর গ্রিন টি। এতে চা পাতার পুষ্টিগুণ অটুট থাকে পূর্ণমাত্রায়। সতেজ সবুজ পাতা রোদে শুকিয়ে তাওয়ায় সেঁকে গ্রিন টি তৈরি করা হয়। এতে এমন কিছু উপাদান আছে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। গবেষকরা বলেন, নিয়মিতই এই চা পান করলে মূত্রথলি, পাকস্থলীর ক্যান্সারসহ সব ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। গ্রিন টিতে থাকা পলিফেনল শরীরের অক্সিডেশন বাড়ায়, যা শরীরের বাড়তি ক্যালরি ক্ষয় করে ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। গ্রিন টিতে ট্যানিক অ্যাসিড থাকে, যা মুখে ইনফেকশন সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করে দাঁতের ক্ষয়রোধে সাহায্য করে এবং মাড়ি মজবুত করে। এ ছাড়া শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে সেখানে গ্রিন টির লিকারে তুলা ভিজিয়ে লাগিয়ে দিলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। পোকামাকড় কামড়ানোর পর যদি ক্রমাগত চুলকাতে থাকে বা ফুলে যায়, তাহলে সেখানে ভেজা সবুজ চা-পাতা দিয়ে ঢেকে দিলে আরাম বোধ হয়।
উলং টি : গ্রিন টি অল্প পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় উলং টি। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পর উলং চায়ের লিকার খেলে কোলেস্টেরল বাড়ার আশঙ্কা কমে যায়। রক্তে লৌহ-কণিকার প্রাধান্য থাকলে প্রধান খাবারের পরপরই চা পান করা ভালো। এতে লৌহ শোষণের মাত্রা কমে যায়। বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের খাবার খাওয়ার পরপর উলং টি পানের পরামর্শ দেওয়া হয়।
দুধ চা : পুষ্টিগুণের বিচারে সবচেয়ে কম উপকারী দুধ চা। যদিও দুধে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিন ‘এ’, আয়রন ও শক্তির উৎস। চায়ে দুধ মেশালে এসব পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়। তবে দুধ চা তৈরিতে অনেকক্ষণ ধরে চা পাতা ফোটানো হয়। ফলে ক্যাফেইনের মাত্রা বেড়ে ঘুমের সমস্যা, মাথা ঘোরানো, অস্থিরতা, উচ্চ রক্তচাপ ও হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত দুধ ও চিনি মিশিয়ে চা পান করলে চায়ের ক্যালরি আরও বেড়ে যায়। ফলে ওজন বৃদ্ধি পাওয়া, ডায়াবেটিস বেড়ে যাওয়াসহ আরও অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
লেখক : পুষ্টিবিদ, সেবাঘর ডটকম