চাঁদপুর-শরীয়তপুর নৌ-রুটে হরিণা ফেরীঘাটে বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের জিম্মি করে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের অর্থ। আর্থিক অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে এই ঘাটটি। ফেরীঘাট ইজারাদার ও বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ দিয়েছে চালকরা। যদিও ইজারাদার প্রতিনিধি এসব অভিযোগ ভিত্তিহীণ বলে দাবি করছে।
যানবাহনের চালকরা জানায়, ২০০১ সালে চাঁদপুর শরীয়তপুর নৌ-রুটে ফেরী চলাচল শুরু হয়। এরপর ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে এই নৌ-রুটটি। শুরুর দিকে ফেরী পারাপার করতে চালকদের কোন বিরম্ভনায় পড়তে না হলেও ঘাট ইজারা দেওয়ার পর থেকে শুরু হয় সমস্যা। ঘাটের টার্মিনালে যানবাহন অবস্থান করতে ২৪ ঘন্টায় যানবাহনের প্রকার ভেদে ২০ থেকে ৭৫ টাকা রাখার কথা থাকলেও তা নেওয়া হচ্ছে ৬শ’টাকা বা তারও বেশি। তাছাড়া ৫-৬ হাজার টাকার মাধ্যমে কোন লাইন না ধরেই ফেরী পাড়ের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে থাকে ইজারাদার প্রতিনিধিরা। এতে করে অনেক চালকরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও ফেরী পার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ থেকে নির্ধারিত ফেরীঘাটের টার্মিনাল চার্জ ২৪ ঘন্টায় বাস, ট্রাক, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেলার, ট্যাংক লরি ও মিনিবাস ৭৫টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপভ্যান ও স্টেশন ওয়াগন ৪০টাকা, কার ও জীপ ৩৫টাকা, টেম্পো, সিএনসি চালিত অটোরিক্সা, বেবি ট্যাক্সি, অটোবাইক ৩০টাকা এবং ভ্যান ও মোটরসাইকেল ২০টাকা নির্ধারণ করা হলেও নেওয়া হচ্ছে কয়েকশ’গুন বেশি।
মালামাল নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আসা ট্রাকের চালক মো. শিপন, আব্দুল্লাহ, মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা গত ১৫ ফেব্রুয়ারী ট্রাক নিয়ে চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাটের টার্মিনালে এসেছি। কিন্তু এখনও আমরা ফেরী পাড় হতে পারিনি। কিন্তু অনেক চালক ঘাটে এসে ইজারাদার প্রতিনিধিদের ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দিয়ে কোন সিরিয়াল না ধরেই ফেরী পার হয়ে যাচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসি দায়িত্বরত টিকেট কালেক্টররা চালকদের যে রশিদ দেয় তার চেয়ে কয়েকশ’ টাকা বাড়তি হাতিয়ে নিচ্ছে। ঘাট ইজারাদার বা টিকেট কালেক্টরদের চাহিদা মত টাকা না দিলে ফেরী পার হতে পারে না চালকরা। এতে করে বিপাকে পড়তে হয় আমাদের। ইজারাদারের লোকজন মোটা অংকের টাকা পেলে সিরিয়াল ছাড়াই গাড়ি ফেরী পাড়ের ব্যবস্থা করে দেয় বলে জানায় তারা।
বিআইডব্লিউটিসি (বাণিজ্য) চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক ফয়সাল আলম চৌধুরী বলেন, ফেরীঘাটের ইজারাদারের বিরুদ্ধে বিগত সময়ে আমরাও অনেক অভিযোগ পেয়েছি। আমরা তদন্ত করে এর ইজারাদারের বিরুদ্ধে বাড়তি টাকা নেওয়ার সত্যতাও পেয়েছি। এ ঘটনায় ইজারাদারের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনের নিকট অভিযোগও প্রদান করা হয়েছে। অতীতে বিআইডব্লিউটিসির কয়েকজন ফেরীর টিকেটের বাইরে টাকা নেওয়ায় তাদেরকে বিভাগীয় শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। এখনো যদি কেউ এর সাথে জড়িত থাকে তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে সরকার নির্ধারিত টার্মিনাল চার্জের বাইরে টাকা নেওয়া কথা অস্বীকার করে চাঁদপুর হরিণা ফেরিঘাট ইজারাদার প্রতিনিধি মো.শাহজালাল বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে একটি চক্র মিথ্যা তথ্য দিয়ে আসছে। সরকারের নির্ধারিত টাকার বাইরে কোন অর্থ গ্রহণ করি না। একটি চক্র এই ঘাটের ইজারা নেওয়ার পায়তারা করছে। তারাই আমাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ চাঁদপুর জেলা বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ফেরীঘাটের টার্মিনাল ব্যবহারে নির্ধারিত টাকার বাইরে অর্থ আদায় করা সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু বর্তমান ইজারাদারের বিরুদ্ধে বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ পেয়েছি। তাদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। ফেরীঘাট এলাকায় সরকারের নির্ধারিত শুল্ক হারের তালিকা টানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ইজারার লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ এক কোটি ৫১ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ইজারাদার মোজাম্মেল হোসেন টিটুর নিকট ১০ মাস ১০ দিনের জন্য হরিণা ফেরিঘাট ইজারা দেয়। এই ঘাট থেকে গত ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে প্রায় দুই কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৮লক্ষ টাকার রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে।
চাঁদপুর-শরীয়তপুর এই নৌ-রুটে প্রতিদিন ৫টি ফেরী চলাচল করে থাকে। চট্টগাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ এই অঞ্চলের বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন প্রতিদিন এই রুট ব্যবহার করে বরিশাল, খুলনা, মাদারীপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করে থাকে। প্রতিদিন এই রুট ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের দেড় থেকে দুইশ’ যানবাহন ফেরী পারাপার হয়। দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই রুটটি। তাই সচেতন মহলের দাবি, ফেরীঘাটে চালক ও যাত্রীদের জিম্মি করে অবৈধভাবে অর্থ আদায় বন্ধ করেতে কর্তৃপক্ষ দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
স্পেশাল করেসপন্ডেট,৪ মার্চ ২০২০