২০১৫ সালে মুক্তমত প্রকাশের জন্য প্রথমে হুমকি এবং পরে হামলার শিকার হয়েছেন ৮জন ব্লগার ও প্রকাশক। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সকল হত্যাকাণ্ড ও হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মূল অপরাধীরা এখনও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য থানায় আগাম জিডি করা হলেও হামলা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি মুক্তমনা লেখক-প্রকাশক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তথা ব্লগারদের উপর হামলা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশে লেখকদের উপর প্রথম হামলার ঘটনাটি ঘটে গত আশির দশকের শেষ দিকে। এ সময় ‘মাধবী সংবাদ’ নামক একটি উপন্যাস লেখার জন্য চলচ্চিত্র জগতের লোকদের হামলার শিকার হন লেখক ও চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন। এরপর ২০০৪ সালে অমর একুশের বইমেলায় নৃশংস হামলার শিকার হন প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ।
মূলত হুমায়ুন আজাদের উপর হামলার মধ্য দিয়েই বর্তমান ধারার সূত্রপাত হয় বলা চলে। এছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশে লেখালেখির কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন কবি দাউদ হায়দার এবং নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তসলিমা নাসরিন। এছাড়া সেই সময় কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফকেও ‘মুরতাদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। অবশ্য তারা তিনজনই এখন প্রয়াত।
বিদায়ী বছরে সর্বশেষ (৩১ অক্টোবর শনিবার দুপুরে) রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দীপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হকের ছেলে।
একই সময় লালমাটিয়া সি-ব্লকের ৮১৩ নম্বর বাসায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশিদ টুটুল, লেখক ও ব্লগার রণদীপম বসু ও তারেক রহিম গুরুতর আহত হন। ফয়সল আরেফিন দীপন ও আহমেদুর রশিদ টুটুল দুজনই মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক।
চলতি বছরে এরা ছাড়াও চারজন অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট বা ব্লগারকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকারীদের কৌশলগুলো হচ্ছে— একাধিক মানুষ কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া, হত্যাকাণ্ডে ধারালো অস্ত্রের ব্যবহার, হত্যার জন্য নির্জন জায়গা বা নিরিবিলি পরিবেশ অথবা কক্ষ বেছে নেওয়া। এ ছাড়া হত্যা মিশনের সময় ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত কোপের জন্য টার্গেট করা হয়।
ভিকটিম, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে এ সব তথ্য জানা যায়।
এর আগে, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়, অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু, মুক্তমনা ব্লগের আরেক ব্লগার, লেখক ও ব্যাংক কর্মকর্তা অনন্ত বিজয় দাস, ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল), গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আহমেদ রাজিব হায়দার শোভনকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের গোড়ানে ৭ আগস্ট খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল)। দুপুরে জুমার নামাজের সময় যখন বেশিরভাগ মুসল্লি মসজিদে তখন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসায় ভাড়া নেওয়ার কথা বলে ঢুকে পড়েন দুর্বৃত্তরা। নিলয় নীল নামে বিভিন্ন ব্লগ ও ফেসবুকে তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি খিলগাঁও গোড়ানের ১৬৭ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার বাসায় স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে থাকতেন। তিন বছর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিভাগে মাস্টার্স পাস করেন।
১২ মে সকাল ৯টায় সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় অনন্ত বিজয় দাস নামে এক ব্লগারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত এ ব্লগার রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার বেগুনবাড়ি এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার সময় আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এছাড়াও আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরার পথে পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম চলতি মাসের প্রথমদিকে জানান, পুলিশ তার কর্তব্য দায়িত্বের সঙ্গে পালন করছে। যদি তা না-ই হতো তাহলে লালমাটিয়ায় আহত তিন লেখককে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হতো না। ব্লগার হত্যার মামলাগুলোতে কোন অগ্রগতি নেই বলে যারা এ ধরনের মন্তব্য করছেন তারা না জেনেই কথা বলছেন।
তিনি জানান, রাজীব হায়দার হত্যাকান্ডে ইতোমধ্যেই চার্জশিট তৈরি হয়েছে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে ৮ জন আটক রয়েছে। নীলাদ্রি নীল হত্যায় ৪ জন আটকসহ অন্যান্য সকল মামলার কার্যক্রম নিজ গতিতে এগিয়ে চলেছে।
অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট আহমেদ রাজিব হায়দার শোভন হত্যাকাণ্ডে ৭ আসামিকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে এ ঘটনার একজন আসামি এখনো পলাতক রয়েছে। জনসাধারণের সহায়তায় অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়া দুজনকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা যায়, হামলাকারীরা মনে করে মুরতাদ, নাস্তিক ও ইসলাম অবমাননাকারীদের হত্যা করতে হবে। অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট যাদের এ পর্যন্ত খুন করা হয়েছে তাদের দৃষ্টিতে এরা সকলেই মুরতাদ, নাস্তিক ও ইসলাম অবমাননাকারী। গুলি করে হত্যা করলে সওয়াব কম। তাই তরবারি, চাপাতি, রামদা অথবা চাইনিজ কুড়াল দিয়েই কুপিয়ে হত্যা করতে হবে। এর মধ্যে গলায় অথবা ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা করলে সওয়াব আরও বেশি। তাই তারা গলা অথবা ঘাড় টার্গেট করে সব সময় কোপ দেয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এ্যান্ড অপস্) শেখ মারুফ হাসান বলেন, ‘আহত ও নিহতদের মাথায়, ঘাড়ে, হাতে আঘাত করছে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ ছাড়াও র্যাব, সিআইডি ও ডিবি এ ঘটনাগুলোর তদন্ত করছে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের হামলায় যারা আহত ও নিহত হয়েছেন তাদের শরীরে একই ধরনের আঘাতের চিহ্ন লক্ষ্য করা গেছে।’
নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৯:০৮ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫, সোমবার
এমআরআর