ওষুধ বাজারজাতকরণে কোম্পানিগুলোর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ওষুধটির উপকরণ, কার্যকরিতা ইত্যাদি সম্পর্কে চিকিৎসকদের অবহিত করতে এবার ভিন্ন কৌশলে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করছে।
হাসপাতালের অভ্যন্তরে কিংবা আঙ্গিনায় এমআরদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রোগীর স্বজন বেশে হাসপাতালে নিত্যদিন নজিরবিহীনভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। কৌশলে যখন-তখন চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকে দীর্ঘ সময় অবস্থান করছেন তারা। এতে ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। এমআরদের এমন দৌরাত্ম্যে চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে, বাড়ছে ভোগান্তি।
অভিযোগ রয়েছে, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগের মাধ্যমে রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে কোম্পানিগুলো নিজেদের ওষুধ লিখতে চিকিৎসকদের প্ররোচিত করছে এবং অন্য কোম্পানির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দখল করতে নানা ধরনের সুবিধাও দিচ্ছে। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির হাতে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এতে ওষুধ নিয়ে এক ধরনের অসুস্থ বাণিজ্য চলছে। সেই সাথে চিকিৎসকদের হাত ধরে রোগীদের সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে নিম্নমানের ওষুধ। এ কারণে দরিদ্র ও অসহায় মানুষগুলো প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আরও পড়ুন… ঔষধ কোম্পানি প্রতিনিধিদের দখলে চাঁদপুর সরকারি হাসপাতাল প্রাঙ্গন
সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার এমআর কাজ করছেন। ওষুধের বিক্রি বাড়ানোর কাজে নিয়োজিত এসব প্রতিনিধির ওপর বিক্রির-লক্ষ্য পূরণে নিজ নিজ কোম্পানির দিক থেকে প্রচন্ড চাপ থাকে। লক্ষ্য পূরণের জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে এমআররা বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার দেন ডাক্তারদের।
এসব সুবিধা নিয়ে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে বেশি ওষুধ লিখতে তারা অনেক সময় বাধ্য হন। এক্ষেত্রে কনিষ্ঠ চিকিৎসকরাই এমআরদের প্রধান টার্গেট। অনেক সময় সিনিয়র ডাক্তাররা তাদের পছন্দের কোম্পানির ওষুধ লিখতে কনিষ্ঠদের বাধ্য করেন। অথচ বেশি দূরে নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ‘উপহার’ নিলে শাস্তি হিসেবে চিকিৎসা সনদ তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জন্য বাতিল করে দেয় চিকিৎসকদের সংগঠন মেডিকেল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানা যায়, আগে সপ্তাহে দুইদিন রোব ও বুধবার দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালের ভিতরে এমআরদের প্রবেশের অনুমতি ছিল। কিন্তু তারা নিয়ম ভঙ্গ করে যেকোনো সময় হাসপাতালে প্রবেশ করে ডাক্তারদের বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করছেন। অনেক সময় ডাক্তারদের কাছে অনৈতিক ভাবে বিভিন্ন বিষয় দাবিও করতেন। নির্ধারিত সময় ছাড়া এমআরদের সময় না দিতে প্রত্যেক চিকিৎসককে চিঠি দিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
প্রবেশপথে নিরাপত্তারক্ষীদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবুও হাসপাতালে এমআরদের দৌরাত্ম্য কমেনি।
সর্বশেষ সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক কর্তৃপক্ষ ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদেরকে হাসপাতালের অভ্যন্তরে কিংবা আঙ্গিনায় অবস্থান না করতে নির্দেশ দেয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানানো হয়।
এরপর হাসপাতালে প্রবেশে এমআরদের কৌশল পাল্টে যায়। এবার তারা প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রোগীর স্বজনের বেশে হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করে ওষুধের প্রচারণা চালাচ্ছেন। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে পড়ছেন তারা।
সরেজমিনে সদর হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, এমআরদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মত। শিশু ওয়ার্ড, মেডিসিন ওয়ার্ড, গাইনি ওয়ার্ড, কিডনি রোগ, কার্ডিওলজি ও সার্জারি ওয়ার্ডে এমআরদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। একই সাথে হাসপাতালের ডাক্তারদের রুমে এমআরদের সাথে বৈঠকরত অবস্থায়ও দেখা যায়। রোগী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বের হলেই তারা কৌশলে ছবি তুলে নিচ্ছেন। এতে ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন চিকিৎসা নিতে আসা অসহায় রোগীরা।
জানা যায়, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির বিচরণ কেবল সদর হাসপাতালেই নয়,জেলার প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও প্রাইভেট চিকিৎসকদের চেম্বার থেকে রোগী বের হওয়া মাত্রই ঘিরে ধরছেন এবং প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলছেন। প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল নিজেদের কোম্পানির ওষুধ লেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন ও দামি উপহার দেওয়া হচ্ছে ডাক্তারদের। ডাক্তাররা ঠিকমতো ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের নাম লিখছেন কিনা প্রতিনিধিরা পরখ করে দেখছেন ছবি তুলে।
ডাক্তারদের দেয়া উপহারের মধ্যে কোম্পানির হরেক রকম দামি ওষুধ, ঘড়ি, খাবার, এয়ারকুলার, ফ্রিজ, কলম, প্যাড, ব্যাগ, মগসহ দেশে-বিদেশে সেমিনারে স্পন্সর, সবই করা হচ্ছে ওষুধের কাটতি বাড়িয়ে মুনাফা লাভের আশায়। কোন কোন কোম্পানি ডাক্তারদের নগদ টাকারও অফার দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে যেভাবে ওষুধ কোম্পানির এমআররা হাসপাতালে ডাক্তারদের কাছে ওষুধের প্রচারণা চালান, তা পৃথিবীর আর কোনো দেশে দেখা যায় না। সরকারি নিয়ম ভঙ্গ করে যারা হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম ব্যাহত করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা জরুরি। সেই সাথে হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা।
তাছাড়া সদর হাসপাতালে প্রবেশ মুখে এমআর দের মোটরসাইকেল দিয়ে রাস্তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেবা নিতে আসা মুমূর্ষু রোগীদের জটিল অবস্থা সৃষ্টি করছে।
হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে সরকারি নির্দেশনা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে অনুপ্রবেশ করে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম ব্যাহত করে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী।
স্টাফ করেসপন্ডেট,১২ জানুয়ারি ২০২১