চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৬তম জন্মদিন আজ

আজ ১ জুন। চাঁদপুর সরকারি কলেজের ৭৬তম জন্মদিন। ১৯৪৬ সালের এই দিনে অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাঁদপুর সরকারি কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তবে ১৯৪৬ সালের ১৫ জুন কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। শিক্ষা, ঈমান ও সেবা এই ব্রত নিয়ে চাঁদপুর এবং আশেপাশের জেলাসমূহের দানশীল ব্যক্তিদের অনুদানে কলেজটির কার্যক্রম শুরু হয়। কলেজটির আয়তন এখন ১৬.৫৬ একর। তবে কলেজের নামে রেকর্ড আছে ১২.২২ একর এবং ভূমিদস্যুরা ৪.৩৪ একর নিজেদের নামে রেকর্ড করে নেয়।

কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি একটু মজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকার কুমিল্লায় বিমান হামলার আশংকা করে ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির মানবিক শাখা (বা কলা শাখা) চাঁদপুরে স্থানান্তর করেন। ভিক্টোরিয়া কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক বাবু পরেশ চন্দ্র গাঙ্গুলী কে অধ্যক্ষ (১ম অধ্যক্ষ) হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। কলেজের ক্লাস শুরু হয় হাসান আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে।

যুদ্ধ শেষে ভিক্টোরিয়া কলেজের মানবিক শাখাটি আবার কুমিল্লায় ফিরিয়ে নেয়া হয়। তখন চাঁদপুরের সুধীজনেরা তৎকালীন সাব-ডিভিশনাল অফিসার (এসডিও) জনাব আফতাব আহমদ খানের কাছে চাঁদপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। জনাব আফতাব আহমদ খান চাঁদপুরের সুধীজনদের নিয়ে একটি সভা করেন এবং চাঁদপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আজিজ আহাম্মদ ময়দান (মহকুমা ক্রিড়া সংস্থার মাঠ) এর পরিত্যক্ত সেনা ছাউনিতে প্রাথমিক ভাবে কলেজের কার্যক্রম শুরু করা হয়। এ মাঠের পশ্চিম পাশে কলেজের মূল ভবন স্থাপন করা হয়।

কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যারা জমি দান করেছেন, তারা হলেনঃ শ্রী নির্মল প্রসাদ সেনগুপ্ত, শ্রীমতি স্বর্ণকুমারী দত্ত, শ্রীমতি প্রতিমা রাণী কর, শ্রী ধীরেন্দ্র নারায়ন চৌধুরী, শ্রী দীনেশ চন্দ্র বসু এবং আজিজ আহাম্মদ ময়দানের পক্ষে এর গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট জনাব ফজলে রাব্বি খান। তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। কলেজের ৬.০৮৫ একর জায়গা সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়।

উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক (পাস), ১৭টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান), ৭টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ১ম পর্ব এবং ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ পর্ব পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে চাঁদপুর সরকারি কলেজে।

১৯৯১-৯২ সেশনে বাংলা এবং হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম অনার্স এর শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৯৩-৯৪ সেশনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি; ১৯৯৬-৯৭ সেশনে রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান; ১৯৯৮-৯৯ সেশনে ইংরেজি, ইতিহাস ও ব্যবস্থাপনা; ১৯৯৯-২০০০ সেশনে ভূগোল, সমাজকর্ম ও পদার্থবিজ্ঞান; ২০০৬-০৭ সেশনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন এবং ইসলামিক স্টাডিজ অনার্স কোর্স চালু করা হয়। মাস্টার্স শেষ পর্ব চালু করা হয় প্রথম ১৯৯৪-৯৫ সেশনে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৯৭-৯৮ সেশনে ইংরেজি, ব্যবস্থাপনা ও ইতিহাস; ১৯৯৯-২০০০ সেশনে রসায়ন, গণিত, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান; ২০০২-০৩ সেশনে সমাজকর্ম ও ভূগোল এবং ২০১৭-১৮ সেশনে পদার্থবিজ্ঞান, দর্শন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে মাস্টার্স শেষ পর্ব চালু করা হয়। বর্তমানে কলেজটিতে ১৬৪৮৭ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।

কলেজটি ১ মার্চ ১৯৮০ সালে সরকারীকরণ করা হয়। সরকারীকরণ এর সময়ে একজন অধ্যক্ষ, একজন উপাধ্যক্ষ, ১৬টি সহযোগী অধ্যাপক, ১৭টি সহকারী অধ্যাপক, ৩৩টি প্রভাষক এবং ১টি গ্রন্থাগারিক পদ আত্তীকরণ করা হয়। মোট ৬৯ টি পদ।

১৯৮৪ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক স্মারক 4E-1/84/348-Edn, date:07/04/1984 থেকে দেখা যায়, সে সময় চাঁদপুর সরকারি কলেজ ৬৯ টি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা, ৩২ টি স্টাফ পদ ছিল। অর্থাৎ মোট পদ ১০১ টি। কিন্তু ঐ একই সময়ে ঢাকার কবি নজরুল কলেজে ৬৫+৪০=১০৫; ইডেন মহিলা কলেজে ১০৫+৫৪=১৫৯; ঢাকা কলেজে ৯৪+৫৪ =১৪৮ টি পদ ছিল। এমনকি মাউশিতে ৩৮+১৮৮=২২৬ টি পদ ছিল। তখন সরকারি কলেজ ছিল ১০৫টি, টিটি কলেজ ছিল ১০টি এবং সরকারি মাদ্রাসা ছিল ০২টি। দেখা যাচ্ছে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে পদ সৃষ্টি করা হয়েছে সেভাবে চাঁদপুর সরকারি কলেজে শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হয় নি। যা দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক।

১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ চাঁদপুর সরকারি কলেজে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও হিসাববিজ্ঞান বিষয়ের প্রতিটিতে ১টি অধ্যাপক, ১টি সহকারী অধ্যাপক ও ১টি করে প্রভাষক মোট ১২টি পদ সৃষ্টি করা হয়।

২ মে ২০০৪ এ ব্যবস্থাপনা বিভাগে ১টি সহযোগী অধ্যাপক এবং ইংরেজি বিভাগে ১টি প্রভাষক পদ সৃষ্টি করা হয়।

১২ সেপ্টেম্বর ২০০৪ ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ১টি সহযোগী অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হয়। ২১ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ১টি প্রভাষক পদ সৃষ্টি করা হয়।

অর্থাৎ বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ১টি অধ্যক্ষ, ১টি উপাধ্যক্ষ, ৪টি অধ্যাপক, ১৮টি সহযোগী অধ্যাপক, ২১ টি সহকারী অধ্যাপক, ৩৯ টি প্রভাষক ও ১টি গ্রন্থাগারিক নিয়ে ৮৫টি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা পদ রয়েছে।

এনাম কমিশনের সুপারিশ ছিল উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির জন্য ২টি, স্নাতক (পাস) কোর্সের জন্য ৪টি, অনার্স বিভাগের জন্য ৭টি পদ এবং মাস্টার্স বিভাগসমূহে ১২টি করে পদ থাকবে। সে হিসেবে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ২০১ টি পদ থাকার কথা। অথচ শিক্ষক পদ আছে ৮২টি। তাহলে চাঁদপুর সরকারি কলেজে আরো ১১৯ পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ২০১ জন শিক্ষকের কাজ ৮২ জন শিক্ষক দিয়ে চালিয়ে নেয়া যায় না, এতে শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। স্নাতক (পাস) কোর্সের শিক্ষক প্যাটার্ণ দিয়ে মাস্টার্স শ্রেণির কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

চাঁদপুর সরকারি কলেজের আরেক সমস্যা হচ্ছে শ্রেণি কক্ষের সংকট। একটি দশ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করে এ সমস্যার সমাধান করা জরুরি।
বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ দাশ স্যার ২৬ তম অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ আবুল খায়ের সরকার স্যার ১৪ তম উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময়ে কলেজের ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। গত ৭৫ বছরে চাঁদপুর সরকারি কলেজ সৃষ্টি করেছে অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, শিল্পী, সাহিত্যিক আরো নানান শ্রেণি পেশার মানুষ।

স্টাফ করেসপন্ডেট, ১ জুন ২০২২

Share