চাঁদপুর

সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ব্রাদাররূপী বিষাক্ত সাপের বসবাস

মিজানুর রহমান রানা || আপডেট: ০৩:৫০ অপরাহ্ন, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫, শুক্রবার

চাঁদপুর আড়াইশ’ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালটিতে জরুরি বিভাগে বিভিন্ন প্রকার দুর্ঘটনাসহ জরুরি রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্যে প্রতিদিনই ক’জন ব্রাদার, একজন ডিউটি ডাক্তারসহ অন্য কর্মচারীগণ নিয়োজিত থাকেন। এই সেবা চলে ২৪ ঘণ্টাই। এ বিভাগটি কখনো বন্ধ হয় না। এ বিভাগে জরুরি রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে ঘটে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা, যাকে বিষাক্ত সাপের সাথে তুলনা করেছেন সাধারণ মানুষ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ বিভাগে যারা রোগীদের সেবা দিয়ে থাকেন, তারা সবাই যে কর্তব্যনিষ্ঠ নয়, এমনটি নয়, বরং কিছু কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে দু’একজন অথর্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলা করে মাঝে মাঝে সাপের বিষাক্ত ফণা তুলে রোগীকে কামড় দিয়ে মেরেই ফেলেন।

বিষয়টিকে সোজাসাফটা করে বলতে গেলে, যে সাপ দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর ঔষধ তৈরি করা হয়, আবার সেই সাপের বিষাক্ত ফণা তোলা ছোবলে মানুষের মৃতুও হয়। যেমনটি চাঁদপুর আড়াইশ’ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ঘটে মাঝেমধ্যে। সেই ঘটনা সাধারণ মানুষকে বিষাক্ত সাপের বিষের মতো শরীরে তীব্র যন্ত্রণায় ভোগিয়ে তোলে।

জানা গেছে, চাঁদপুর সদর হাসপাতালের ওই বিভাগের কর্মচারীরা চাকুরির পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত অর্থ যোগাড়ের আশায় মাঝে মধ্যে একজন ডাক্তারের দায়িত্বে উদয় হয়ে রোগীকে এমন কিছু চিকিৎসা দিতে যান, যা তাদের কাজের আওতায় পড়ে না। তখনই ঘটে হিতে বিপরীত। ডাক্তার না হয়ে যেমন ব্রাদার ডাক্তারের কাজ করতে গিয়ে রোগীদের হিতে বিপরীত এমনকি জীবনাবসান পর্যন্ত হয়ে যায়। তখনই ঘটনাটি ডালপালা মেলে বিস্তার করে সাধারণ মানুষের মাঝে এবং তা জানাজানি হয়। এ বিভাগে রোগীদের জরুরি সেবা দিয়ে কিছু কিছু ব্রাদার ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা যেমন অতিরিক্ত আয় দাবি করে থাকেন, তেমনি নানাভাবে রোগীদেরকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেন যাতে তারা প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও তাদেরই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ফলে তার একটা ভাগ পাওয়া যায়। এসব কাজ করতে গিয়ে তারা জন্ম দেন অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনার। তেমনি একটি ঘটনা ঘটে গত সোমবার সকালে চাঁদপুর সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে, যা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেওয়ার মতো।

গত সোমবার চাঁদপুর আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট সরাকারি জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে এক ব্রাদারের বা সেবকের গোঁয়ার্তুমিতে মৃত্যুর পথযাত্রী হয় আদনান নামের দেড় বছরের এক শিশু।

সোমবার সকালে প্র¯্রাবজনিত সমস্যার কারণে ওই ব্রাদার কর্তৃক অতিমাত্রার জেসকীন লোকাল দিয়ে অচেতন করে সুন্নত করানোর চেষ্টাকালে শিশুটির নাকে মুখে রক্ত বের হতে থাকে। ওই সময় অবস্থা বেগতিক দেখে শিশু আদনানকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে রেফার করে দেয়া হয়। সেখানে শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসা করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। নিরুপায় হয়ে ওই পরিবারটি শিশুটিকে প্রাইভেট একটি হাসপাতালে করায়। কিন্তু এ বিষয়ে জানতে গেলে ভুল করেও ওই ব্রাদার ‘দায়ী নয়’ বলে তাদের অভিমত জানান। তাদের দাবি, সুন্নত (খতনা) করানো বা লোকাল দেয়ার কারণে নয়, এটি একটি ভিন্ন সমস্য। এর আগেও এমন বহু সুন্নত তারা করিয়েছেন বলে জানান।

এ ব্যাপারে শিশু আদনানের চাচা মোস্তফা জানায়, হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা ইউনিয়নের স্বর্ণা গ্রামের রণি মোল্লার স্ত্রী বিয়ের প্রায় ৮বছর ধরে নিঃসন্তান ছিলো। দেড় বছর পূর্বে তাদের জন্ম নেয় শিশু আদনান। প্রস্রাবজনিত সমস্যার কারণে ওইদিন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. অলিউর রহমানের পরামর্শে তাকে অপারেশনের মাধ্যমে সুন্নত করানোর জন্যে চাঁদপুর আড়াইশ’ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতলে নেয়া হয়। সেখানে জরুরী বিভাগের ব্রাদার ইউসুফ নিজেই সুন্নত (খতনা) করাতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটায়।

তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. অলিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, প্রস্রাবের সমস্যার জন্য আদনানকে সুন্নত করানোটা জরুরী ছিলো। তাই তিনি অপারেশনের মাধ্যমে সুন্নত করানো জন্যে শিশুটির বাবা-মাকে সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র সার্জারী ডাক্তার মনির হোসেনের কাছে তিনি প্রেরণ করেন। আদনানের বাবা শিশুটিকে জরুরী বিভাগে নিয়ে যায়। সেখানে শিশুটির মায়ের বাধাকে উপেক্ষা করে ইউসুফ নামের ওই ব্রাদারের পরামর্শে জরুরি বিভাগেই তার সুন্নত করানো হয়। সুন্নত করানোর সময় শিশুটিকে অচেতন করানোর জন্যে প্রায় ৩ এমএল জেসকীন লোকাল দেয়া হয়। অথচ শিশুটির ওজন মাত্র ৪ কেজি। এই ওজনের শিশুকে কোনোমতেই ১.৫ এমএল-এর বেশি জেসকীন লোকাল (অচেতন ইনজেকশন) দেয়া যায় না। শিশুটির শরীরে অতিমাত্রায় জেসকীন লোকাল প্রবেশের ফলে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়। পরে আদনানের পরিবার বিষয়টি ডাক্তারকে অবহিত করলে তিনি সেখানে ছুঁটে যান এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শিশুটিকে নিয়ে দায়ী ব্রাদার ইউসুফকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে চলে যেতো বলেন। তিনি আরো জানান, “জরুরী বিভাগের ব্রাদার কখনোই সুন্নত বা এধরনের কাজ করার ক্ষমতা রাখে না। এই দায়িত্ব সিনিয়র সার্জারী ডাক্তারের।”

বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে চাঁদপুর আড়াইশ’ শয্যার সরকারি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. প্রদীপ কুমার দত্ত জানান, “ এ কাজটি ব্রাদার ইউসুফের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। মনে করেন, ছাত্র হয়ে যদি শিক্ষকের কাজ করে, তাহলে যেমনটি হয়; ঠিক তেমনটিই হয়েছে ওই শিশু রোগীটির ক্ষেত্রে। ব্রাদার ইউসুফ কোনো মতেই ওই দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তাই আমি অফিসের কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে তার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারিনি। এ বিষয়ে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”

এ ব্যাপারে আদনানের বাবার অভিযোগ করে জানান, ডা. অলিউর রহমান ব্রাদার ইউসুফকে আমাদের সাথে ঢাকায় যাওয়ার কথা বললেও তিনি আমাদের সাথে যেতে রাজি হননি। উল্টো তিনি আমাদের বকাঝকাও করেন।
পরবর্তীতে এ ব্যাপারে যোগাযোগের জন্যে জরুরি বিভাগের ওই ব্রাদার ইউছুফকে পাওয়া যায়নি। তার ফোন নাম্বার চাইলেও তার সহকর্মীরা দিতে রাজি হয়নি। এভাবেই তারা খামখেয়ালিভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কাজ কারবার।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু এক ব্রাদার ইউসুফই নন, এখানে এমন ইউসুফ আরো রয়েছে। যাদের বিষাক্ত ফণায় প্রতিনিয়তই রোগীদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর হুমকি বেড়ে চলছে। তারা তাদের চাকুরির পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ কামাইয়ের জন্যে রোগীকে নিজেরাই ডাক্তার সেজে এমনসব কাজ করে বসেন, যা তাদের প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের আওতায় নেই। সেক্ষেত্রে রোগীদের জীবননাশের সম্ভাবনাই থাকে বেশি।

পাঠক, শেষ হয়েও হচ্ছে না শেষ। আবারও আসছি, তবে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে। সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকুন।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫

Share