সৌদি রাজপরিবারের প্রভাবশালী সদস্য, সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মেদ বিন সালমানের নির্দেশে আটক করার ঘটনা দেশটিতে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।
সরকারিভাবে একে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই বলা হলেও, বিশ্বজুড়ে এই পদক্ষেপকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতা সুসংহত করার প্রচেষ্টা হিসেবে। একে বলা হচ্ছে, সৌদি রাজপ্রাসাদের ‘গেইম অব থ্রোনস’।
এই গ্রেপ্তার ও বরখাস্তের ঘটনা প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন আল ওয়ালিদ বিন তালাল। টুইটার, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স, ফোর সিজন্সসহ বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী আল ওয়ালিদের।
তবে যুবরাজ আবদুল্লাহ শুরু থেকেই বেশ শক্ত আচরণ করছেন। ধারণা করা হয়, ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু করা, উপসাগরীয় প্রতিবেশী কাতারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক লড়াই সব আক্রমণাত্মক সিদ্ধান্ত যুবরাজই নিয়েছেন। কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তের সামান্য সমালোচনাও কঠোর হাতে দমন করছেন।
অনেকটা জোর করে সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন নায়েফকে তার পদবি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীত্ব ত্যাগ করানো হয়। কয়েকদিন আগেও একাধিক বুদ্ধিজীবী, কবি, ধর্মীয় নেতা ও প্রিন্সদের গ্রেপ্তার বা গুম করা হয়েছে। বিশেষ করে সাবেক বাদশাহ আবদুল্লাহর পরিবারকে টার্গেট করা হচ্ছে। সৌদি আরব পরিচালিত হয় রাজপরিবারের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে। রাজপরিবারের অনেকটা অলিখিত নিয়ম হচ্ছে, নিজেদের মধ্যকার যেকোনো দ্বন্দ্ব পরিবারের অভ্যন্তরেই থাকবে। কিন্তু যুবরাজ আবদুল্লাহ বিন সালমান ওই নিয়মের ধার ধারছেন না।
প্রখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক জেমস এম. ডরসি মনে করেন, সৌদি-ইরান প্রক্সি যুদ্ধ যে তীব্রতর হচ্ছে, তারই আলামত হলো সৌদি আরবে খুব দ্রুত ঘটে যাওয়া নাটকীয় সব ঘটনা।
লেবাননে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধির নিন্দা জানিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি পদত্যাগ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, লেবাননের ইরানপন্থী শিয়া হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াদের চাপে ফেলতে সৌদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই হারিরিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। প্রায় একই সময়ে রিয়াদে মিশাইল নিক্ষেপ করেছে ইয়েমেন ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা। ওই মিশাইল ভূমিতে পড়ার আগে মাঝ আকাশে এটি সৌদি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার গোলাতে ধ্বংস হয়ে যায়।
সৌদি সমর্থিত সামরিক জোট কড়া ভাষায় ওই ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। জোটের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি ইরানি শাসকগোষ্ঠীর সরাসরি সামরিক আগ্রাসন, যা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সৌদি আরবের অধিকার রয়েছে ইরানকে যথোপযুক্ত সময়ে ও উপায়ে জবাব দেওয়ার।’
ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক লড়াই ধ্বংসাত্মক হতে পারে, এটি সৌদি নেতৃত্ব জানে। তাই দেশটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইরানের প্রক্সি বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা চালানো হতে পারে। মিশাইল হামলার প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব আপাতত ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সাময়িক আকাশ, নৌ ও স্থল অবরোধ আরোপ করেছে। ইয়েমেনে সৌদি আরবের সামরিক হস্তক্ষেপের পর এক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেন লাখ লাখ মানুষ কলেরায় আক্রান্ত। আরব বিশ্বের দরিদ্রতম দেশটি দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে। ফলে এই সৌদি অবরোধে দেশটির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাবে।
এদিকে বার্তা সংস্থা এপি প্রকাশ করেছে বিস্ফোরক খবর। এতে সূত্রের উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি সৌদি আরবে অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে আছেন! মূলত, সুন্নি হাদির সরকারকে শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা করছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট।
বলা হচ্ছে, ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চল এখন জোটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই দক্ষিণাঞ্চলে হাদি সমর্থিত সেনাদের নিয়ন্ত্রণ মোটামুটি ছিল। কিন্তু সৌদিতে আশ্রয়ে থাকা হাদি বারবার অনুরোধ করেও দেশে ফিরতে পারছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, জোটের প্রভাবশালী সদস্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে হাদির দ্বন্দ্বের কারণেই তার এই অবস্থা!
শুধু ইয়েমেন নয়। সৌদি আরব-ইরান দ্বন্দ্বের ছাপ পড়ছে লেবাননেও।
লেবাননে জাতি ও গোত্রগত এবং ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বহু আগ থেকেই বেশ প্রবল। এ নিয়ে অনেক সংঘাতও পোহাতে হয়েছে দেশটিকে। কিন্তু ঘরের পাশে সিরিয়ায় দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধ চললেও, অলৌকিকভাবে নিজেদের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে পেরেছে লেবানন। এমনকি প্রচুর সিরিয়ান শরণার্থী দেশটিতে প্রবেশ করলেও অত সমস্যা হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হারিরি পদত্যাগ করায় এখন অস্থিতিশীলতা উস্কে উঠতে পারে।
এখন পর্যন্ত হারিরির পদত্যাগের পেছনে সৌদি আরবের ভূমিকা থাকার স্বপক্ষে পরোক্ষ প্রমাণের বেশি কিছু নেই। হারিরি বলেছেন, তিনি তার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিতা রফিক হারিরির মতো হত্যার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করছেন। তাকে হত্যার একটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলেও গুজব রয়েছে। পদত্যাগের সময় দেওয়া বিবৃতিতে তিনি স্পষ্টভাবেই সৌদি আরবের পক্ষালম্বন করেন।
হারিরি বলেন, ‘আরব বিশ্বকে ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত ইরান। সব আরব রাজধানীতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ থাকা নিয়ে ইরান গর্বও করে। অস্ত্রের জোরে লেবাননে এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা তৈরি করেছে ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ। তাদের হস্তক্ষেপের কারণে আরব প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমাদের ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে।’ কিন্তু যে কারণে হারিরির পদত্যাগের পেছনে সৌদি আরবের হাত থাকার জোর গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো, হারিরি নিজ দেশে নন, বরং সৌদি রাজধানী রিয়াদে দেশটিরই আল আরাবিয়া টিভি চ্যানেলে ওই পদত্যাগের ঘোষণা দেন। মজার ব্যাপার হলো, আল আরাবিয়া টিভি চ্যানেলের মালিক হলেন ওয়ালিদ বিন ইবরাহিম আল-ইবরাহিম, যিনি প্রিন্স সালমানের নির্দেশে শনিবার আটক হওয়া ব্যবসায়ীদের একজন।
হারিরি পরিবারের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক বহুদিনের। সাদ হারিরি সৌদি ও লেবানিজ দ্বৈত নাগরিকত্বধারী। হারিরি পরিবারের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ‘সৌদি ওগার’ এ বছরের শুরুর দিকে দেউলিয়া হয়ে পড়ে।
এ নিয়ে তেমন সন্দেহই নেই, সৌদি আরব চায় লেবাননে হিজবুল্লাহর অবস্থান দুর্বল করতে। কিন্তু এটি স্পষ্ট নয় কেন হারিরির পদত্যাগ চাইলো দেশটি। হারিরিকে ভাবা হয় লেবাননের সবচেয়ে গণ্যমান্য সুন্নি রাজনীতিক। তিনি দেশের রাজনৈতিক কাঠামোতে হিজবুল্লাহর অবস্থানকে স্বীকার করেছেন, যে সংগঠনের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে তার পিতাকে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।
লেবানিজ রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ায়, সৌদি আরব এখন হিজবুল্লাহর ওপর আরও প্রভাব ফেলার সুযোগ পাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, লেবানন রাষ্ট্র ও সামরিক বাহিনী দুর্বল থাকায় হিজবুল্লাহর পাখনা কেটে ফেলার পূর্বতন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
হিজবুল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছে, হারিরির পদত্যাগ তাদের কাম্য ছিল না। লেবাননে অস্থিতিশীলতা তৈরি হোক, সেটিও তাদের চাওয়া নয়। এই সংকট শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হোক, এটিই তারা চায়। কিন্তু পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ তাদেরও কম। এই সংকটের ফলে হিজবুল্লাহ সমর্থিত খ্রিস্টান প্রেসিডেন্ট মিশেল আয়োনকে সরে যেতে হতে পারে। আরও ভয়াবহ হতে পারে, যদি এই সুযোগে হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়।
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ইসরাইলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড্যান শ্যাপিরো সম্প্রতি ইসরাইলের হারেৎস পত্রিকায় লেখা নিবন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছেন, সৌদি আরব হয়তো ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ বাধাতে চায়। ইসরাইলের উচিত হবে না সৌদি ফাঁদে পা দেওয়া।
নিজের নিবন্ধে শ্যাপিরো ব্যাখ্যার সুরে লিখেছেন, ‘হারিরিকে পদচ্যুত করিয়ে, সৌদি আরব চায় লেবাননের অস্থিতিশীলতার দায় পড়–ক হিজবুল্লাহর ওপর।
ফলে লেবাননের কঠিন সব চ্যালেঞ্জ, সিরিয়ান শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণ এবং আল কায়দা ও আইসিস-এর সহযোগী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্বও হিজবুল্লাহর ঘাড়ে। সৌদিরা হয়তো ধারণা করছে, এর মাধ্যমে হিজবুল্লাহ এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে। ফলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সংগঠনটি ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবে।’ যুদ্ধ শেষ হতে হতে সিরিয়া যুদ্ধ থেকে ফেরত ক্লান্ত হিজবুল্লাহ বেশ দুর্বল অবস্থায় থাকবে। আর এটিই সৌদি আরবের চাওয়া।
সাবেক সেনা জেনারেলদের বৈশ্বিক সংগঠন ‘হাই লেভেল মিলিটারি গ্রুপ’ এই মাসে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, রক্তাক্ত সংঘাত প্রত্যাসন্ন হয়তো নয়, কিন্তু অনিবার্য। নিজেদের ৭৬ পৃষ্ঠার রিপোর্টে প্রতিষ্ঠানটি লিখেছে, ‘হিজবুল্লাহ চায় না এখনই ইসরাইলের সঙ্গে লড়াই শুরু করতে। আগে সিরিয়ায় নিজেদের অবস্থান সুসংহত ও লেবাননে প্রস্তুতি নিতে চায় তারা। তবে তাদের কর্মকা- ও প্রচার থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সংগঠনটি মনে করে যেকোনো মুহূর্তে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ লড়ার সামর্থ্য তাদের রয়েছে। ফলে সম্ভাব্য যুদ্ধ কখন হবে তা শুধু ইরান ও লেবাননের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে না, ভুল হিসাব নিকাশের ওপরও নির্ভর করছে।’
ইয়েমেন ও লেবানন হয়তো ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বের সাম্প্রতিক ভেন্যু। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কেবল এই দুই দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। সিরিয়ান সংঘাতে এই দুই দেশ প্রতিপক্ষ ছিল। ইরাকে প্রভাব-পতিপত্তি অর্জনের লড়াইও ছিল তাদের। পাশাপাশি, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশকেও নজরে রেখেছে সৌদি আরব। কখনও ইরানে গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব উস্কে দিতে চাইলে ইরান সীমান্তবর্তী বেলুচিস্তানকে ব্যবহার করার ইচ্ছা সৌদির।
পরিস্থিতি আরও উস্কে দিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হারিরির পদত্যাগের ঘটনা বিশ্বের জন্য জেগে উঠার ডাক। তিনি বলেছেন, ইরানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসবের কোনো কিছুই মধ্যপ্রাচ্যের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনার লক্ষণ নয়। সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকিই শুধু তৈরি হয়নি, এই অঞ্চলে গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পাওয়ার হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এমন একটি অঞ্চল যেখানে দেশে দেশে সংখ্যালঘুরা খুবই ঝুঁকিতে থাকেন। সুন্নি ও শিয়া সম্পর্ক দিনে দিনে শীতল হচ্ছে। আর মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধগুলোর সবচেয়ে বড় ভিকটিম সবসময়ই সাধারণ মানুষ।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ২ : ০৩ পিএম, ৮ নভেম্বর, ২০১৭ বুধবার
ডিএইচ