চাঁদপুর শহরে হারিয়ে যাচ্ছে পুকুরের ঐতিহ্য, প্রাণ খুলে গোসলে নেই স্বস্তি

একসময় পুকুরে গোসল ছিলো চাঁদপুর শহরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। পানির স্বস্তি, ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে প্রাণ জুড়ানো, বিকেলের আলোয় পাড়ঘেঁষে গল্প, সব মিলিয়ে পুকুর ছিলো একান্ত আবেগ ও প্রয়োজনের জায়গা। আজ সেই চিত্র শুধুই স্মৃতি। আধুনিক নগরায়ণ, দখল ও অদূরদর্শী পরিকল্পনার বলি হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদপুর শহরের পুকুরগুলোর ঐতিহ্য।

একসময় চাঁদপুর শহরের প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লাতেই ছিলো একাধিক পুকুর। আদালত পাড়া, পাল পাড়া, প্রফেসর পাড়া, ট্রাক রোড, মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী সড়ক, শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রম এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ছিলো পরিচ্ছন্ন ও রক্ষণাবেক্ষণকৃত বহু পুকুর, যা গোসল করা, পানীয়, মাছ চাষ ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো পুকুর গুলো।

শহরের প্রবীণ নাগরিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৫–৩০ বছর আগেও চাঁদপুরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মালিকানাধীন পুকুর ছিলো সাধারণ চিত্র। শিশু থেকে বৃদ্ধ, ছাত্র থেকে দিনমজুর, সবার জীবনেই পুকুর ছিলো একটি অনিবার্য অবলম্বন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একে একে এসব পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়েছে। কোথাও গড়ে উঠেছে দালান, কোথাও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোথাও পাকা রাস্তা। কারো কারো দাবি, নিজস্ব প্রয়োজনে বা উন্নয়ন কাজের নামে পুকুর ভরাট করা হলেও এর অধিকাংশই হয়েছিলো বিনা অনুমতিতে বা প্রভাবশালীদের চাপে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পুকুর মানে শুধু জলাধার নয়, এটা একটি শহরের পরিবেশের শ্বাস-প্রশ্বাস। পুকুর হারালে শহরের মাটি শুকিয়ে যায়, পানির স্তর নিচে নেমে যায়, আর জলাবদ্ধতা বেড়ে যায়।

সব পুকুর হারিয়ে না গেলেও অবস্থা আশঙ্কাজনক। শহরে এখন হাতে গোনা যে ক’টি পুকুর রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জোড়পুকুর পাড় পুকুরটি শহরের ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলোর মধ্যে একটি। এখনো কিছু মানুষ গোসল ও ব্যবহারের জন্য এই পুকুরে আসেন। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই পুকুরও ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাচ্ছে।
এছাড়া স্টেডিয়াম সড়কের বক্ষব্যাধি হাসপাতাল সংলগ্ন এই পুকুরটি এখনো টিকে আছে। তবে তার পানি অনেকটাই দূষিত। আগে শহরের এই সড়কের অনেক মানুষজন ওই পুকুরটিতে গোসল করতো স্বাচ্ছন্দে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে পুকুরটির আশে পাশের ডোবা এবং খালি জায়গা গুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সেটির পানিও এখন অনেক দূষিত হয়ে গেছে। এজন্য মানুষজন এখন সেটিতে গোসল করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আগের তুলনায় শহরে তেমন পুকুর না থাকায় শহরের বহু মানুষ এখন প্রাকৃতিক জলাধার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ।
এছাড়া চাঁদপুর শহরের মাদরাসা রোড বর্তমান আউটার স্টেডিয়ামটি যেখানে সেখানেও বিশাল একটি দীঘি ছিলো। যেটিতে একসময় শহরের বিভিন্ন এলাকার মানুষজন গোসল করতো বেশ আনন্দের সাথে। প্রায় ২০/২৫ বছর আগে সেই দীঘিটি ভরাট করে আউটার স্টেডিয়াম তৈরি করা হয়। তারপর থেকেই মানুষজন দীঘিতে গোসল করার আনন্দ অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। তার আশে পাশে এবং বাসস্ট্যান্ট শেরে বাংলা ছাত্রাবাসেও একটি পুকুর রয়েছে। তবে সেটির সেই পুরনো সৌন্দর্য আর স্বচ্ছ পানি এখন আর নেই।
অনেকে বলেন, এখন আর শহরের পুকুরে ডুব সাতারে প্রাণ খুলে গোসল করার সেই সুযোগ নেই। সেগুলো এখন যেনো সোনালী অতিত। গোসলের জন্য টিউবওয়েল বা গভীর নলকূপই ভরসা। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা জল আর নেই, সেই আরামও নেই।
তরুণরা আজ সাঁতার শেখেনা, শিশুরা জলে ডুবে খেলতে শেখে না। শহরের শিশুরা জানেই না পুকুর মানে কী! আবার বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। কারণ বৃষ্টির পানি যাওয়ার মতো স্বাভাবিক জলাশয় আর নেই।
পুকুর শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও নিরাপত্তা। এখন সময় এসেছে পুকুর রক্ষা ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার। পৌরসভা বা জেলা প্রশাসনের উচিত শহরের যেসব পুকুর এখনও টিকে আছে, তা সংরক্ষণে আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করা। পুরনো পুকুরগুলোর ঐতিহাসিক মূল্যায়নে শহরের পরিকল্পনায় নতুন জলাশয় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরী বলে মনে করছেন চাঁদপুরবাসি।

প্রতিবেদক: কবির হোসেন মিজি,২৯ জুন ২০২৫