চাঁদপুর দেশের আলু উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়। কৃষি ক্ষেত্রে আলুর অবদান কম নয় । আলু উৎপাদনে মুন্সিগঞ্জের পরেই চাঁদপুরের অবস্থান।
এ বছরই চাঁদপুর জেলায় আলু উৎপাদন লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় বা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এবার চাষাবাদ মৌসুমে ৪ দিনের টানা অকাল বৃষ্টিতে আলুর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ফলে রোপণকৃত আলু বীজ নষ্ট হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামার বাড়ি চাঁদপুরের সূত্র মতে, চলতি ২০১৭-১৮ বছরে জেলায় আলুর চাষাবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৮ শ’ ৯০ হেক্টর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৭২ হাজার মে.টন। চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় চাষাবাদ হয়েছে ১০ হাজার ৫শ’৭৭ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার মে.টন। বছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১ লাখ ৪ শ’মে.টন আলু উৎপাদন কম হয়েছে। চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেয়া পরিসংখ্যান তথ্যে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে।
কারণ হিসেবে কৃষি বিভাগ জানায়, চাঁদপুরে চাষাবাদ মৌসুমে ৪ দিনের টানা অকাল বৃষ্টিতে আলুর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রোপণকৃত আলু বীজ নষ্ট হয়েছে। একদিকে আলু উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্থ অপরদিকে হাজার হাজার টাকা ধার দেনা করে লোকসানে কৃষকগণ হতাশ হয়ে পড়েন। সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে মতলব দক্ষিণ উপজেলার নিচু এলাকায় ২ হাজার ২শ’হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছিল।
প্রাপ্ত তথ্যে মতে,চাঁদপুর সদরে চাষাবাদ হয়েছে ১ হাজার ৯শ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ২৭ হাজার ৮শ’৭১ মে.টন। হাইমচরে চাষাবাদ হয়েছে ২শ ১৫ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ১শ’ ৯০ মে.টন। মতলব উত্তরে চাষাবাদ হয়েছে ৯শ ৫০ হেক্টর এবউৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৫শ’ মে.টন। মতলব দক্ষিণে চাষাবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৬শ ৫০ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ৫৭ হাজার ২শ’ ৫০ মে.টন।
হাজীগঞ্জে চাষাবাদ হয়েছে ৯শ ৫০ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৬শ’৩৪ মে.টন। শাহরাস্তিতে চাষাবাদ হয়েছে ২৫ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ৪শ’৭০ মে.টন,। কচুয়া চাষাবাদ হয়েছে ৩ হাজার ৪শ ৫০ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ৫৩ হাজার ৪শ’৬৭ মে.টন। ফরিদগঞ্জে চাষাবাদ হয়েছে ১শ ৪০ হেক্টর এবং উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ২শ’৪০ মে.টন।
এদিকে চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় ৫ উপজেলায় কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে ১২ টি। সবগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৫৪ হাজার মে.টন। এবছরও প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার মে.টন আলুর সংরক্ষণের বাহিরে থেকে গেছে। কোনো কোনো চাষি বা মধ্যস্বত্বভোগী দৈনন্দিন বাজারে খুচরা বিক্রি করছে। আবার ওইসব আলু চাষীদের পরিচর্যায় ঘরের মাচায় বা মেঝে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষণ করে রাখার উদ্যোগ নিতে হয়েছে।
এছাড়া আলু আমাদের দেশের প্রধান সবজি। চাঁদপুরে এর ফলন বেশি। ভাতের বিকল্প হিসেবে আলুর ভূমিকা রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগিদের আলু খেতে নিষেধ নেই। আলুর বহুমুখী ব্যবহারের ফলে এর চাহিদা বাড়ানো আরো সম্ভব । সারা বছরই সবজি হিসেবে আমাদের দেশে আলুর বেশ চাহিদা রয়েছে। সকল বয়সের মানুষ আলু খেতে পছন্দ করেন।
নদী বিধৌত চাঁদপুরে আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশ,আলু পরিবহনে সুবিধা, কৃষকদের আলু চাষে আগ্রহ, কৃষি বিভাগের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রযুক্তি প্রদান, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত,কৃষিউপকরণ পেতে সহজলভ্যতা,বীজ ,সার ও কীটনশাক ব্যবহারে কৃষিবিদদের পরামর্শ,ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে কৃষিঋণ প্রদান ইত্যাদির কারণে চাঁদপুরের আলুচাষীরা আলু চাষে আগ্রহী।
চিকিৎসকগণ ডায়াবেটিক রোগীদের পরিমাণ মত আলু খেতে পরামর্শ দেন। সবজি ছাড়াও আলু দিয়ে প্রায় ১ শ’প্রকারের মুখরোচক খাবার তৈরি করা যায় বলে কৃষিবিদগণ দাবি করেন। গৃহিণীরাও আলুর তৈরি বিভিন্ন প্রকার খাবার বানাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সব বয়েসীরা আলুর তৈরি খাবার পছন্দ করেন।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল,কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা দুপুরে গেইটে আলুর তৈরি খাবার খেতে তারা খুবই অভ্যস্থ। দেশের বেশিরভাগ হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বিভিন্ন খাবারের দোকানে আলুর রকমারী খাবার তৈরি করে রসনা বিলাসদের তৃপ্তি প্রদান করে থাকে। বড় বড় সামাজিক অনুষ্ঠানে খাবারের ম্যানুর সাথে আলু থাকছেই। চাঁদপুরের ক্ষুদ্র ও মাঝারী চাষি ও ব্যবসায়ীরা উৎপাদনের দিকে লোকশান হলেও দামে তারা লাভবান হচ্ছে ।
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ খামারবাড়ির একজন কর্মকর্তা বলেন,‘চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে এবার আলু চাষাবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭শ’৬০ মে.টন। এতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ১শ’ ৮৮ মে.টন। এবার চাষাবাদ হয়েছে ১০ হাজার ৮ শ’ ৯০ হেক্টর।
মৌসুমী বায়ূর প্রভাবে অনবরত ২-৩ দফায় অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতে কৃষকগণ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় এবার উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৫ শ ৭৭ মে.টন।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কৃষিবিদরা আলু সংরক্ষণের জন্যে চাষীদেরকে সব ধরণের পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে ভবিষ্যতে চাঁদপুরে বেসরকারিভাবে উদ্যোক্তারা কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করলে লোকসান হবে বলে মনে হয় না।’
চাঁদপুরের আলু চাষিরা বিভিন্ন জাতের আলু চাষাবাদ করে থাকে। কম-বেশি সব উপজেলাই আলুর ফলন ও চাষাবাদ হয়ে।বিগত ক’বছর ধরেই চাঁদপুরে ব্যাপক আলু উৎপাদন হয়ে আসছে। ফলে আমাদের দেশে আলুর উৎপাদন বাড়িয়ে বিদেশে রফতানি বৃদ্ধি সম্ভব ।কেননা বাংলাদেশের উৎপাদিত আলু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আলুর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, জাপান, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের আলু রপ্তানি হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়-বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আলু উৎ্পাদিত হলেও মুন্সীগ্ঞ্জ , চাঁদপুর, দিনাজপুর, রংপুর, জয়পুরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও জেলায় বেশি পরিমাণ আলু উৎ্পাদিত হচ্ছে।
উ’পাদিত উন্নতজাতের আলুর মধ্যে রয়েছে ডায়মন্ড, গ্রানূলা, কুমারিকা ও সাগিতা জাতের আলু বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। গত কয়েক বছর আগে থেকেই আলু রপ্তানি শুরু হয়।
বাংলাদেশের আলুর বড় ক্রেতা ছিল রাশিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের আলুর মধ্যে ভাইরাস পাওয়ায় রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে আলু নেয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সম্প্রতি মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে বেশি পরিমাণ আলু নিচ্ছে।
এক তথ্যে জানা যায়, ২০১৭ সালে আলুর মৌসুমে বিশ হাজার টন আলু মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে। ইদানিং উত্তরবঙ্গে বেশ কিছু উদ্যেক্তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আলু উৎ্পাদনে নেমেছে।
এতে করে আলু চাষিদের মাঝে নতুন করে উৎ্সাহ দেখা দিয়েছে। আলুর চাষ বেড়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। জমি থেকে আলু সংগ্রহের পর আলু বাছাই, গ্রেডিং, ওজন, প্যাকিং, ট্রাকে লোড করাসহ বিভিন্ন কাজে অনেক লোক নিয়োজিত হচ্ছে। এসব শ্রমিকের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি।
আলু রপ্তানি হওয়ায় চাষিরা ব্যাপকভিত্তিতে আলু চাষের উদ্যোগ নিচ্ছে। উচ্চফলনশীল ও রপ্তানিযোগ্য উন্নতজাতের আলু বেশি করে চাষ করলে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এতে আর্থিকভাবে লাভবান হবেন আলু চাষিরা।
আলুর রপ্তানি ক্রমেই বৃদ্ধি করা গেলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়বে। এতে জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। দেশে আলুর উৎ্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিত্যক্ত জায়গাগুলো আলু চাষের আওতায় আনতে হবে। দেশের বেকারদেরকে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে জমির বন্দোবস্ত দিতে হবে। এতে করে লাভবান হবে দেশ।
।প্রতিবেদক : আবদুল গনি
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৯:১০ পিএম,২৭ জুন ২০১৮। বুধবার
ডিএইচ