সারাদেশ

প্রবাসীদের অ্যাকাউন্ট থেকে লাখ লাখ টাকা উধাও !

লন্ডন প্রবাসী জগলুল বাশার চৌধুরীর ইসলামী ব্যাংকের দনিয়া শাখায় একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তার ওই হিসাব নম্বরে সাধারণত মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়।

চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি তার স্বাক্ষর করা একটি চেক ব্যাংকে জমা দেন শাহানা বেগম নামের এক নারী। দাপ্তরিক নিয়ম-কানুন শেষে জগলুলের হিসাব থেকে ১৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয় ওই নারী প্রাপকের হিসাবে।

এর পাঁচ দিন পর আবারও ১২ লাখ টাকার চেক জমা পড়ে। এবারও প্রাপক একই নারী। এ পর্যায়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। তারা প্রবাসীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন- কাউকে এরকম কোনো চেক দেননি জগলুল।

পরীক্ষায় দেখা যায়, ব্যাংকে জমা দেওয়া চেক ও তাতে জগলুলের স্বাক্ষর, সবই নকল। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে, প্রবাসীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কৌশলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র।

এমন পাঁচটি ঘটনায় অন্তত এক কোটি ২২ লাখ ৮৩ হাজার টাকা আত্মসাতের তথ্য পাওয়া গেছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক ইমাম আল মেহেদী জানান, জালিয়াতির এই চক্রে ছয় থেকে আট সদস্য রয়েছে। তাদের চারজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই প্রতারকরা দেশের বিভিন্ন স্থানে নকল চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। এর আগে তাদের কেউ চেকদাতা গ্রাহক সেজে বিদেশ থেকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ফোন দেয় এবং ভুয়া ই-মেইল পাঠায়। ফলে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা কঠিন হয়ে পড়ে।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রানা চৌধুরী বৃহস্পতিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, এই চক্রের সদস্যরা সাধারণত গ্রাহক পরিচয়ে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের কাছে ফোন দিয়ে অ্যাকাউন্টের স্থিতি (কত টাকা জমা আছে) জানতে চায়। একই সঙ্গে জানিয়ে দেয়, ফ্ল্যাটের দাম বাবদ বা অন্য কোনো কারণে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার চেক একজনকে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যেন তাকে সেই টাকা দিয়ে দেয়।

জগলুল বাশার চৌধুরীর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তোলার আগেও ফোন করে ও ই-মেইল পাঠিয়ে চেক দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতারকরা। এর ভিত্তিতে প্রথম দফায় শাহানা বেগমের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা স্থানান্তর করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয় দফায় টাকা তোলার সময় জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে তাকে পরদিন যেতে বলা হয়। তবে শাহানা ব্যাংকে যান ১ মার্চ। সেদিন তাকে আটকে রেখে র‌্যাব সদস্যদের কাছে সোপর্দ করা হয়। ২ মার্চ এ ঘটনায় কদমতলী থানায় মামলা হয়।

প্রথমে থানা পুলিশ ও পরে সিআইডির ডেমরা ইউনিট মামলাটির তদন্ত করে। ধীরে ধীরে চক্রের সবাইকে শনাক্ত করা হয়। গ্রেফতার করা হয় চক্রের সদস্য আবদুস সালাম মিলন, আবুল কালাম ওরফে রানা চৌধুরী ও তানিয়া আক্তার তানিশাকে। তানিয়ার বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জের সদর থানায় ২৫ লাখ ও টঙ্গিবাড়ী থানায় ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে মামলা রয়েছে। চক্রের হোতা মোহাম্মদ হানিফ এখনও পলাতক।

সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, জালিয়াতির উদ্দেশ্যে চক্রের সদস্যরা গ্রাহকের মূল ই-মেইল ঠিকানার প্রায় অনুরূপ একটি ঠিকানা খুলে নেয়। এ ক্ষেত্রে মূল ঠিকানার সঙ্গে একটি ‘ডট’ বা ‘ড্যাশ’ পার্থক্য থাকে; যা যাচাইকারীর চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। চেক জালিয়াতির জন্য তারা আরেকটি কৌশল ব্যবহার করে।

টার্গেট ব্যক্তি যে ব্যাংকের যে শাখার গ্রাহক, সেই শাখাতেই চক্রের একজন অ্যাকাউন্ট খোলে। এরপর তার পাওয়া চেক বইটির পাতা নিয়ে ঘষামাজা করে। এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে চেকটির মূল ক্রমিক নম্বর পাল্টে টার্গেট গ্রাহকের চেকের নম্বর বসিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত তারা মূল গ্রাহকের চেক বইয়ের শেষের দিকের পাতাগুলোর নম্বর ব্যবহার করে। এতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

তদন্ত সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তুলে নেওয়ার তথ্য তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখা থেকে ৩২ লাখ, ইসলামী ব্যাংকের মুন্সীগঞ্জ শাখা থেকে ২৫ লাখ, দনিয়া শাখা থেকে ১৫ লাখ ও অগ্রণী ব্যাংকের টঙ্গিবাড়ী শাখা থেকে ৪৫ লাখ টাকা তোলার কথা জানা গেছে।

এ ছাড়া কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ১৬ অক্টোবর সাকিনা বেগম নামে এক নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি একই কায়দায় নকল চেক দিয়ে পাঁচ লাখ ৮৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখছে সিআইডি। (সমকাল)

Share