চাঁদপুর

চুরি-মাদক-মানবপাচারের নেপথ্যে হাকিম-রৌশনারা পরিবার

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক :

চাঁদপুর শহরে ইদানীং মাত্রাতিরিক্ত চুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে চলছে মাদক ব্যবসায়ীদের রামরাজত্ব। বিষয়টি যেনো একই সূত্রে প্রোথিত। অনুসন্ধানে নানাজনের সাথে কথা বলেই এরকমই খবর পাওয়া গেছে।

গত ক’দিনের অনসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুর শহরের চক্ষু হাসপাতাল ও ডায়াবেটিক হাসপাতাল সংলগ্ন একটি পরিবারের সরাসরি পরিচালনায় বেশ কিছু লোকজন এই মাদক ব্যবসা, বিভিন্ন দেশে যাবার জন্যে ভিসার দালালী ও শহরের চোরদের চুরির বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে চাঁদপুরকে একটি অশান্ত শহরে পরিণত করে তুলছে।

চাঁদপুর শহরে সাম্প্রতিক সময়ে দিনে ও রাতে বেশ ক’টি চুরি সংঘটিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিএম টাওয়ারে চুরি, ডায়াবেটিস হাসপাতাল সংলগ্ন খুকুর মোটরসাইকেল চুরি, ডায়াবেটিস হাসপাতালে চুরি, ওই হাসপাতালের বিপরীতে মা ফার্মেসীতে চুরি, গণির ওয়ার্কশপে চুরি, বিষ্ণুদী রোডে মোস্তফা গাজীর দোকানে চুরি, শেরে বাংলা সড়কে তাহের প্রধানিয়ার বাসায় চুরি, চক্ষু হাসপাতালের মালামাল চুরি, আজমীর মেডিকেল হলে চুরি সংঘটিত হয়। এসব স্থানে চোরের দল সংঘবদ্ধ হয়ে দুর্ধর্ষ চুরি সংঘটিত করে। যা তাদের গডফাদারদের আঁতাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব চোর, মাদক ব্যবসায়ীদের গডফাদার হচ্ছে ডায়াবেটিস হাসপাতাল সংলগ্ন বিষ্ণুদী রোডের হাকিম-রৌশনারা নামের একটি পরিবার চক্র। সাম্প্রতিককালে চাঁদপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি পরিবার যেমন পুরো শহরকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিলো, ঠিক তেমনি এই হাকিম ও রৌশনারা পরিবারও বর্তমানে ডায়াবেটিক-চক্ষু হাসপাতাল, চেয়ারম্যানঘাটসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম করে ওই এলাকাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই পরিবারের হাকিম ও তার স্ত্রী রৌশনারা এবং তাদের সঙ্গীয় হান্নান মিজি, মোস্তফা মিজি এলাকা চুরি-ডাকাতির নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা, মাদক ব্যবসা এবং আদম ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার ফায়দা লুটে নিয়েছে। বর্তমানেও এরা বিদেশে মানুষ পাঠানোর নাম করে মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। মানুষকে বিদেশে পাঠানোর নাম করে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে। এদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই ঘরভিটে বিক্রি করে সর্বস্ব হারিয়ে পথে নেমেছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ওই পরিবারটি গ্রীসে শ্রমিক পাঠানোর নাম করে চাঁদপুরের সহজ-সরল অনেক মানুষের সাথে প্রতারণা করে তাদেরকে পথে বসিয়েছে। জানা গেছে, এসব সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও তারা কাউকে বিদেশ পাঠাতে পারেনি এবং ওইসব মানুষের টাকা-পয়সা ফেরতও দেয়নি। উপরন্তু যারা তাদের টাকা ফেরত চেয়েছে তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি ও মামলা মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে তাদের জীবনকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। এর মধ্যে শহরের বিষ্ণুদী এলাকার বাসিন্দা হানিফ সরকারের ছেলে কবির সরকার, কুমিল্লা রোডের আলি মিজির ছেলে সুমন মিজি, রহমতপুর কলোনীর আনোয়ার মুন্সির ছেলে মহিউদ্দিন রনি, মাদ্রাসা রোডের রাসেলসহ অনেককেই গ্রীসে ভালো কাজের কথা বলে ভিসা দেয়ার নাম করে তাদের সাথে প্রতারণা করেছে ওই পরিবার। এছাড়াও তারা গলাকাটা ভিসা, ভুয়া ভিসার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, অনেক মানুষকে বিদেশে পাচার করে বন্দী অবস্থায় জিম্মি রেখে ওই দম্পতি তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে মুক্তিপণ হিসেবে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছে। এসব নিয়ে গত ক’বছর ধরে এলাকায় ওই দম্পতিকে নিয়ে অনেক সালিশ বৈঠক বসেছে, কিন্তু বিষয়টি সুরাহা কেউ করতে পারেনি।

এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পরিবারের মূল শেল্টার দিচ্ছে পর্দার অন্তরারলের কিছু লোকজন। এছাড়া শুধু হাকিম-রোশনারাই নয়, তার সাথে রয়েছে তার পরিবারের এবং পরিবারের বাইরের আরো অনেক লোকজন। যারা প্রতিনিয়ত চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় চুরি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে আশ্রয়প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। তাদের ৫ সন্তানের মধ্যে দু’সন্তান রহিম ও হাবিব বিদেশে লোক নেওয়ার নাম করে এলাকার মানুষকে সর্বস্বান্ত করে বাকি দু’সন্তান মোস্তফা ও হান্নান এখন ওই এলাকায় চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, মাদক ব্যবসায় মনোনিবেশ করেছে। ফলে এসব অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে তাদের নামে রয়েছে ব্যাপক মামলা মোকদ্দমা। এসব মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে তারা বেশ ক’বার গ্রেফতারও হয়েছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে জামিনে এসে তারা আবারও জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে।

জানা গেছে, বিদেশে মানুষ পাঠানোর নামে প্রতারণার অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালে মামলা দায়ের করেন জিটি রোডের আ. মান্নানের স্ত্রী হাজেরা বেগম। (মামলা নং-১৪) ওই মামলায় ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার হয় হাকিম মিজি ও তার স্ত্রী রৌশনারা বেগম। শুধু তাই নয়, ওই মামলা তাদের গ্রেফতার করলেও দালাল চক্রের তদবীরের কারণে রাতেই তাদেরকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এরপর বিভিন্ন অভিযোগে ওই দম্পতির নামে আরো মামলা হতে থাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে হাকিম মিজির পরিবারের সদস্য হান্নান মিজি ও মোস্তফা মিজি তাদের অপকর্ম ঢাকতে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরে যোগ দিয়ে শহরে ব্যাপক অপকর্ম ও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দেয়। ফলে তারা শহরে বোমাবাজি, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ ইত্যাদিতে জড়িয়ে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। যার কারণে হেফাজতের মামলাসহ একাধিক মামলার এজাহারভুক্ত আসামী হিসেবে এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়।

আরো জানা গেছে, এই পরিবারটি এলাকার ছাত্তার মিজি গং, মতিন মিজি গং, রশিদ মিজি গংসহ তাদের আপন ভাই কাশেম মিজি ও তার আপন বোন পেয়ারা বেগমকে মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করার জন্যে জেল হাজতে ঢুকিয়েছে। এসব মিথ্যা মামলায় ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে তাদের ওয়ারিশানগণকেও বঞ্চিত এবং বিতাড়িত করে। সর্বশেষ জানা যায়, ২২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে হাকিম মিজির বাসার পাশে মা ফার্মেসীর পিছনের ওয়াল ভেঙ্গে যাবতীয় মালামাল চুরি ঘটনার নেপথ্যে হাকিম-রোশনারার পুরো পরিবারের সাথে নিলু, নাছির, নাইমুলসহ বাইরের বেশ কিছুর যোগানদাতার সম্পৃক্ততার খবর পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে মা-ফার্মেসীর মালিক ওমর ফারুক চাঁদপুর মডেল থানায় ১টি মামলা দায়ের করে। (৪৪/২৬৬, তাং ২২/০৪/২০১৫)।

মামলার বাদী ওমর ফারুক জানান, চাঁদপুর মডেল থানার এএসআই নন্দন প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা সাপেক্ষে মামলা রুজু করেন এবং পরবর্তিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মহিউদ্দিন ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে অদৃশ্য কারণে আসামীদেরকে হাতের নাগালে পেয়েও গ্রেফতার করেননি, যা স্থানীয় গণমাধ্যমে ব্যপকভাবে আলোচিত হয়েছে।

এদিকে আরো জানা যায়, রৌশনারা বেগম ও তার মেয়ে ফাতেমা আক্তার মহিলা হওয়ার সুবাদে মায়াকান্না করে অর্থের জোরে তদবীরের মাধ্যমে আওয়ামী ঘরানার লোকজনের নাম ব্যবহার করে। এবং নামকাওয়াস্তে কিছু দালাল, সালিশি চক্র এবং ছদ্মবেশী জনপ্রতিনিধি দাবিদার ব্যক্তিবিশেষের মাধ্যমে লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি ও বিভ্রান্ত করছে। ওই পরিবারকে স্থানীয় আওয়ামী ঘরানার দাবিদার কিছু লোক আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। ফলে তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে এরা এলাকায় চুরি-ডাকাতি, মাদক ও মানব পাচার ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত। আর এর দায় দায়িত্ব পড়ে সরকারের কাঁধে। অথচ চাঁদপুর শহরকে একটি আধুনিক মডেল শহরে রূপান্তর করার চেষ্টা এলাকার জনপ্রতিনিধি ডা. দীপু মনির ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফল। সেই সাথে চাঁদপুর পৌর মেয়রও চাঁদপুরের উন্নয়নের নানা চেষ্টায় তৎপর। সেই চাঁদপুরের সুনামহানি করার জন্যে থানা ও দলীয় লোকজনের দোহাই দিয়ে ওই হাকিম ও রৌশনারা পরিবার কাজ করে যাচ্ছে।

এসব বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না থাকার কারণে এলাকার লোকজন মনে করে প্রশাসনের নীরব কোনো ভূমিকা রয়েছে। তাই তাদের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যার ফলে এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন তাদের ভয়ভীতির কারণে মুখ খুলতে সাহস পায় না। কারণ সালিশী দালাল চক্র পক্ষপাতিত্বের জন্য, বিভিন্ন মামলায় আটক হওয়ার পরও থানা হাজত থেকে তদবীরের মাধ্যমে বের হয়ে আসা, পুলিশ কর্তৃক চার্জশীটে তাদের নাম প্রত্যাহার করা এবং ভয়ভীতি, হুমকি ধমকি প্রদর্শন ইত্যাদি।

স্থানীয় কমিশনার মালেক মিয়ার সাথে আলাপকালে তিনি এসব অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে জানা নেই বলেন, তবে প্রভাবশালী কিছু লোকের সাথে হাকিম মিজিদের কিছু সমস্যা থাকতে পারে বলে জানান।

এ বিষয়ে অভিযুক্তদের একজন হাকিম মিজির স্ত্রী রোশনারা বেগমের কাছে অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি স্থানীয় সাবেক জনৈক ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলতে অনুরোধ করেন এবং জানান ওই ব্যক্তি তাদের অভিভাবক।

শহরের একাধিক চুরির ঘটনা নিয়ে চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, চুরির ঘটনা নিয়ে একাধিক মামলা হয়েছে এগুলো নিয়ে মামলার তদন্ত চলছে।

উল্লেখ্য গত ২৮ মে বুধবার চাঁদপুর জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাসিক মিটিংয়েও শহরের হঠাৎ করে চুরি ও মাদক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। উক্ত সভায় জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে এসব অপরাধ দমনে আরো কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।

স্থানীয় এলাকাবাসী ও সচেতনমহল মনে করছেন সকল অভিযোগ ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি জরুরী।

তথ্যসূত্র : স্থানীয় একাধিক দৈনিক অবলম্বনে।

আপডেট :   বাংলাদেশ সময় : ১২ আষাঢ় ১৪২২ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার ২৬ জুন ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ, ০২:২১ অপরাহ্ন

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫

চাঁদপুর টাইমস ডট কম-এ প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Share