আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের কেউ ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাকে আওয়ামী লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন কঠোর হুঁশিয়ারি ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এবার চেহারা দেখে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। জনবিচ্ছিন্ন এমপিরা দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। শেষ মুহূর্তেও দলীয় মনোনয়ন পরিবর্তন করা হতে পারে।
গতকাল শুক্রবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় শেখ হাসিনা আরো বলেন, শুধু উন্নয়ন দিয়ে ভোট পাওয়া যায় না। ভোট পাওয়া যায় ভালোবাসা দিয়ে।
কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে বিদ্রূপ করে ‘তেঁতুল হুজুর’ না বলা এবং তাঁর সম্পর্কে সব ধরনের নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম আর জামায়াত এক নয়। এরা পরস্পরবিরোধী। এদের এক করে দেখা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আচরণে আর কখনই যাতে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা অসন্তুষ্ট না হন।’ ১৪ দলের শরিকরাও যাতে হেফাজতের বিরুদ্ধে কথা না বলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি।
সভায় পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। নির্বাচনে আগে ও পরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ওপর মত দেন দলীয় এমপিরা। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আপাতত প্রতি নির্বাচনী এলাকার তিনজন নেতাকর্মী নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তফসিল ঘোষণার পর বিভাগীয় ও জেলাপর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
সভায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি কোর কমিটিসহ ১৫টি উপকমিটি গঠন করা হয়। কোর কমিটির চেয়ারম্যান থাকবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম এবং সদস্যসচিব ওবায়দুল কাদের। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে কারা থাকবেন তা বিস্তারিত জানানো হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এবার দাঁড়ালে এমপি হওয়া যাবে—এটা মনে করেই এবার এত প্রার্থী। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ওভার কনফিডেন্স হওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘ছিয়ানব্বই-দুই হাজার সালেও আমরা অনেক উন্নয়ন করেছিলাম। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তাই ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উন্নয়ন প্রচার করতে হবে। তা নাহলে ভোট পাওয়া যাবে না।’
দলের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সম্পর্কে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগকে আপন ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু আমরা এখনো হেফাজতের আমিরকে তেঁতুল হুজুর বলে বিদ্রূপ করি। ১৪ দলের শরিকরা এ ক্ষেত্রে আরো বেশি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে।’
তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কওমি মাদরাসা সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখানে গরিব মানুষের সন্তানরা পড়াশোনা করে। আমরা আগে জঙ্গি বলতে কওমি মাদরাসার ছাত্রদের বুঝতাম। কিন্তু দেখা গেল জঙ্গি তারা নয়, ধনীর দুলালেরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। সেখানে কোনো কওমি মাদরাসার ছাত্রদের পাওয়া যায়নি।’
ওই সময় কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডু কথা বলার জন্য দাঁড়ালে শেখ হাসিনা রসিকতা করে বলেন, ‘ঠাণ্ডু ঠাণ্ডা মানুষ গরম হলো কেন?’ জবাবে ঠাণ্ডু বলেন, ‘নেত্রী হেফাজতে ইসলামের আমির সম্পর্কে আমাদের ১৪ দলের একজন নেতা নিয়মিত ব্যঙ্গ করে কথা বলেন। এখানে ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম আছেন, তাঁকে বলে দিন যাতে ভবিষ্যতে শরিকরা কেউ হেফাজত সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য না করেন।’ তখন শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন।
গত বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য নিয়েও সভায় আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ড. কামাল হোসেন হয়তো চাচা হিসেবে ওই সব কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগের অনেকে ড. কামালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সভায় নির্বাচনী মহাজোট সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা হয়।
একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চায় ঐক্যফ্রন্ট : এর আগে সভায় সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশটা যে সুন্দরভাবে চলছে, দেশের মানুষ স্বস্তিতে আছে, তাদের ভালো লাগছে না। তারা চায় একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। দেশটাকে অস্থিতিশীল করতে।’ ঐক্যফ্রন্ট নেতারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন চান কি না সে নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘তারা নির্বাচন চায় কি চায় না? সেটাই বড় কথা।’ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জয় হবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন দলীয় প্রধান।
সভায় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদ ও সংসদীয় দলের সদস্যরা।
ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ অধীনে নির্বাচন দাবির সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যেহেতু একটা রায় হয়েছে উচ্চ আদালতে যে কোনো অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না, সেই রায় থাকা সত্ত্বেও আমাদের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী থেকে শুরু করে যারা বড় বড় আইনজীবী তারা কিভাবে দাবি করে যে এখানে আরেকটা সরকার গঠন করে নির্বাচন দিতে হবে! এই দাবিটা কেন? কিভাবে হবে?’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সেই রায়ের পর আমাদের সংবিধান সংশোধন করেছি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ঠিক যে রকম ছিল, যেভাবে নির্বাচনের জন্য যা যা লেখা ছিল, আমরা সেইভাবেই নিয়ে এসেছি।’
ড. কামাল হোসেনের নাম উল্লেখ না করে তার সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘তাহলে একদিকে দাবি করবে সংবিধান রচয়িতা; অন্যদিকে আবার সেই সংবিধানকে লঙ্ঘন করার জন্য নির্বাচনের অন্য ফর্মুলা দিবে, অনির্বাচিত একটা সরকার গঠন করতে বলবে, সরকারকে পদত্যাগ করতে বলবে, এই আব্দারটা কেন? কার স্বার্থে? কিসের স্বার্থে? সেটাই আমরা বুঝতে চাই। কী কারণে তারা এটা চাচ্ছে। তাদের যদি এত শক্তি থাকে জনগণের সঙ্গে আসবে, ভোট হবে।’
ইভিএম নিয়ে বিরোধী দলগুলোর আপত্তির সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ইভিএম দিতে চাই, দ্রুত মানুষ ভোট দিতে পারে। তাতেও আবার আপত্তি কিসের? সেটাও আমরা বুঝতে পারি না। ইভিএম আজকে ইন্টারন্যাশনালি ব্যবহার করে। এতে কেউ কারো ভোট চুরি করতে পারবে না। তাহলে সেখানে কী করে তারা আপত্তি জানায়!’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমরা বিরোধী দলে থাকতে কথা বলা তো দূরের কথা, একটা মিটিংও করতে দেয়নি। আমরা কিন্তু সকলের জন্য সভা-সমাবেশ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। কাউকে বাধা দিইনি। এখন একটা ঐক্যজোট হয়েছে। তারা মুখে বড় বড় কথা বলে আর দুর্নীতিবাজ সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া এবং সাজাপ্রাপ্ত তারেক রহমান তাদের সঙ্গে জোট করেছে। সেই দলসহ বিএনপি-জামায়াত জোট ঐক্য হয়েছে। তারা বলল, আমরা নাকি তাদের মিটিং করতে দিচ্ছি না। সিলেটে তারা মিটিং করল। আগেই তারা বলে, আমাদের দিচ্ছে না। আমার যেটা মনে হয় যে তারা চায় আমরা তাদের বাধা দিই।’
আগামী নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান বলেন, ‘জয় আমাদের হবেই। জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনগণের শক্তি নিয়েই আমরা ক্ষমতায় এসেছি। জনগণের ভোটেই আমরা ক্ষমতায় এসেছি। আমার জনগণের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা, বিশ্বাস আছে। যে উন্নয়নের ছোঁয়া আজকে সকলের জীবনে লেগেছে, নিশ্চয় তারা সেটা ধরে রাখবে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে সরকার গঠনের সুযোগ দেবে। আওয়ামী লীগের জয় হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ আমরা করে রেখেছি, যাতে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত থাকে। আর সেই গতি অব্যাহত থাকবে যদি আওয়ামী লীগ আবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে। তাহলে মানুষ সুন্দর জীবন পাবে। প্রতিটি গ্রাম শহরে রূপান্তর হবে। নাগরিক সকল সুবিধা গ্রামে বসেই পাবে।’ (কালের কন্ঠ)
বার্তা কক্ষ