অল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে এলাকার দরিদ্র, অসহায় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিদ্যমান বিরোধ ও বিবাদ সহজে নিষ্পত্তির জন্য বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত আইনগতভাবে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালের গ্রাম আদালত অধ্যাদেশের বলে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত তার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রচার-প্রচারণা ও প্রয়োগের অভাবে অধ্যাদেশটি ততটা কার্যকর হতে পারেনি। এজন্য ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার পূর্ণাঙ্গ গ্রাম আদালত আইন মহান জাতীয় সংসদে পাশ করে।
শুরু হয় দেশব্যপী এর কার্যক্রম। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালে এ আইনে প্রয়োজনীয় কিছু সংশোধনী আনা হয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে গ্রাম আদালত বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়।
গ্রাম আদালত আইন-২০০৬ এবং বিধিমালা-২০১৬ এর উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ, জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি) ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দেশের প্রত্যন্ত এলাকার মোট ১০৮০টি ইউনিয়নে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের মাধ্যমে এর বিচারিক সেবা সাধারণ জনগণের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ‘বাংলাদেশে গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্প’ নিয়ে কাজ শুরু করে।
তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করার জন্য বিশেষভাবে প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য দেশের ৪টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে প্রকল্পের সহযোগী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। চাঁদপুরে সহযোগী সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ষ্ট্রাষ্ট (ব্লাষ্ট) কাজ করছে।
জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান ও স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোঃ মঈনুল হাসানের সার্বিক সহযোগিতায় চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ, মতলব-উত্তর, মতলব-দক্ষিণ, শাহরাস্তি ও কচুয়া উপজেলায় মোট ৪৪টি ইউনিয়নে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে।
জুলাই-২০১৭ হতে জুন-২০১৮ পর্যন্ত মোট ১৭২১টি মামলা গ্রাম আদালতে দায়ের হয় এবং এ সময়ের মধ্যে ১৫৫১টি মামলা নিস্পত্তি করা হয়। মামলা নিস্পত্তির হার শতকরা ৯০ ভাগ। মামলা নিস্পত্তি হতে গড়ে সময় লেগেছে ৩২ দিন। নিস্পত্তিকৃত মামলার বিপরিতে মোট ৫৯,৮৫,১৬০ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে আদায় করা হয় যা আইন মেনে যথাযথভাবে মামলার ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গ্রাম আদালত সক্রিয়করণের অংশ হিসেবে বিচারিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান, বোর্ড সদস্য, ইউপি সচিব, গ্রাম আদালত সহকারী ও গ্রাম পুলিশদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় গ্রাম আদালতে বিচারিক-পরিবেশ বজায় রাখার জন্য এজলাস, কাঠগড়া, ফরম-রেজিস্টার ও লোকবল সরবরাহ করা হয়েছে। চাঁদপুর স্থানীয় সরকার জেলা শাখার পক্ষে নিকোলাস বিশ্বাস ডিস্ট্রিক্ট ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ) হিসেবে গ্রাম আদালত প্রকল্পের দায়িত্ব পালন করছেন।
গ্রাম আদালতে মামলা খরচ খুবই কম। দেওয়ানী মামলার জন্য ২০ টাকা এবং ফৌজদারী মামলার জন্য ১০ টাকা মাত্র। এই মামলা-ফি ছাড়া এখানে আর কোন খরচ নেই। আইনের ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাম আদালতে বিচারিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়।
দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় মামলার ক্ষেত্রে বর্তমানে গ্রাম আদালতে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে রায় ঘোষণার এখতিয়ার রয়েছে। প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে ৫ জন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালতের বেঞ্চ গঠিত হয়।
এতে সভাপতি হিসেবে থাকেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বাকী চার জনের মধ্যে দুই জন মনোনীত করেন মামলার আবেদনকারী এবং অন্য দুই জন মনোনীত করেন প্রতিবাদী অর্থ্যাৎ যার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নারী বা পুরুষ উভয়েরই বিচার প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। বাড়ির কাছেই গ্রাম আদালত; নিজের পরিচিত পরিবেশে বিচার হয় বলে নারীর জন্য নিজের সব কথা সহজে বলা যায়; নিজের পছন্দমত প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়া যায় বলে নারী বিচার প্রার্থীগণ সহজেই গ্রাম আদালতের মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসার সুযোগ পান।
গ্রাম আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় নারী ও পুরুষ প্যানেল সদস্যদের অধিকার ও গুরুত্ব সমান। প্রত্যেক প্যানেল সদস্যের ভোটের গুরুত্ব সমান। তাছাড়া নারীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন নারী প্যানেল সদস্য নারীর সমস্যাটি ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেন এবং তার পক্ষে অধিকতর জোড়ালোভাবে সমস্যা বিশ্লেষণ ও যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। আদালতে বিচারিক প্যানেলে নারী সদস্য উপস্থিত থাকলে নারী বিচার-প্রার্থীর জন্য তার সমস্যা নিঃসংকোচে বলা সহজ হয়।
গ্রাম আদালতে পক্ষগণ নিজের কথা নিজে বলতে পারেন। এখানে কোনো আইনজীবি দরকার হয় না। গ্রাম আদালত নারী-পুরুষ সবার জন্য নিরাপদ ও ভয়মুক্ত। গ্রাম আদালত দরিদ্র সুবিধা-বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্টির বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কাজ করছে।
তাই, অল্প সময়ে ও স্বল্প খরচে সঠিক বিচার পেতে সাধারণ জনগোষ্ঠী গ্রাম আদালতে আসতে পারেন। গ্রামে অনেক ছোটখাটো ঘটনা ঘটলেও সাধারণ মানুষ তার প্রতিকার চাইতে থানা বা জেলা আদালতে যান যেখানে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হয়।
এটা না করে ভূক্তভুগীগণ গ্রাম আদালতে আসতে পারেন এবং সহজে বিচার চাইতে ও নিতে পারেন। এরফলে উচ্চ আদালতগুলোতে মামলার চাপ অনেক কমে যাবে এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তি ফিরে পাবেন।
(প্রেস বিজ্ঞপ্তি)