নদীবিদৌত জেলা ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। এখানকার পদ্মা-মেঘনা আর ডাকাতিয়া এ তিনটি নদীর মিলনস্থলকে বলা হয় ‘ত্রিনদীর মোহনা’। যাকে কেন্দ্র করে এর তীরে গড়ে উঠেছে জেলার একমাত্র পর্যটন এলাকা। এখানকার নির্মল বাতাস আর নদীতীরে আছড়ে পড়া ডেউয়ের গর্জন যে কোনো ভ্রমণপিপাসু মানুষের মনে অন্যকরম দোলা দেয়। ফলে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুবই পরিচিত এই স্থানটি।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রমণপিপাসুরা আসছেন। কিন্তু বড় স্টেশন মোলহেডের কাছে অবস্থান করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুমোদনহীন নড়বড়ে অনুন্নত নৌযানে ভ্রমণপিপাসুদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই ঝুঁকি অনেক বেশি। এসব ছোট ছোট নৌযানে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য নেই জীবন রক্ষাকারী বয়া, লাইফ জ্যাকেট, দিকনির্ণায়ক যন্ত্রসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি।
নৌযান চালকদেরও নেই কোনো প্রশিক্ষণ এবং জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। যে কারণে ঘটছে স্রোতময় নদীতে প্রাণহানি।
এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন: সুন্দরের আড়ালে এক ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যুকুপ’ চাঁদপুরের ত্রিনদীর মোহনা
জানা যায়, ছোট ছোট স্টিলবডির ট্রলার নৌযানগুলোর নকশা অনুমোদন এবং তাতে সরকার নির্ধারিত সরঞ্জাম রাখার নিয়ম থাকলেও তা বরাবরই থেকেছে উপেক্ষিত।
যে কারণে নাজুক এসব ট্রলার নদীতে ধমকা হাওয়া ও ঝড়ের মুখে পড়লে ডুবে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ট্রলার নিবন্ধন না থাকায় প্রাণহানির সঠিক তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, অনুমতি ও লাইসেন্স নেয়া বাধ্যতামূলক কি না, এ বিষয়টি বোট কর্তৃপক্ষের অনেকেই জানেন না। যেজন্য তারা ঘণ্টাপ্রতি ভ্রমণপিপাসুদের থেকে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা করে নদীপথে ভ্রমণ করাতে ভাড়া আদায় করে থাকে। যদিও এতে কোনোরূপ রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। অথচ এর নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হাতে।
জানা যায়, এসব কাঠ ও স্টিলবডির ট্রলার নদীতে যাওয়ার আগে কতজন ভ্রমণপিপাসু যাত্রী নিয়েছেন এবং তার সঙ্গে এটি নদীতে যাওয়ার সক্ষমতা রাখছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট দফতরকে অবহিত করার কথা থাকলেও তা মানছে না কেহই।
এজন্য সংশ্লিষ্ট দফতরের তদারকি না থাকাকেই দায়ী করেন অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বহুকাল থেকেই এই মৃত্যুকুপে নৌ-যান ডুবে ঘটনা ঘটতে শুরু হয়। এখান পর্যন্ত এই মৃত্যুকুপে এমভি শাহজালাল, মদিনা, দিনার ও নাসরিন-১ লঞ্চসহ অসংখ্য যাত্রীবাহি ট্রলার, মালবাহী নৌকা, কার্গো, জাহাজ তলিয়ে গেছে। বিগত সময়ের এইসব দূর্ঘটনায় হাজারো যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তবে এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমভি নাসরিন লঞ্চ। ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ডুবে যাওয়া লঞ্চটির প্রায় ৯০ ভাগ যাত্রীই মারা যান। ১১০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেলেও নিখোঁজ হয় ১৯৯ জন। আজো পর্যন্ত এখানে ডুবে যাওয়া কোনো লঞ্চের সন্ধান পায়নি বিআইডব্লিউটিএ।
স্থানীয়রা জানায়, ত্রিনদীর এই স্রোতের কারনে মোলহেডের প্রায় আধা কিলোমিটার নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখানে মাছের আড়ত,পাইলট হাইজ ও ২টি স্টিমারঘাট ছিলো, যা নদীর স্রোতে বিলীন হয়েছে। নদীতে তলিয়ে গেছে চাঁদপুরের সাবেক পুরাতন লঞ্চ ঘটটিও। দিন দিনে এখানে ঘূর্ণিস্রোত বেড়েই চলেছে। যার মূল কারণ, বিপরীত পাশে পদ্ম-মেঘনায় জেগে উঠা অসংখ্য ডুবো চর। ডুবচরগুলো খনন না করা করা পর্যন্ত এই স্থানে ঘূর্ণিস্রোতও কমবে না। এই স্রোতের ফলে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধও রয়েছে মারত্মক ঝুঁকির মধ্যে।
চাঁদপুরের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমেদ জানান, চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত ২৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় তারা অংশ নিয়েছেন। যেখান থেকে তারা ২০টি লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে সব নৌযান দুর্ঘটনার খবর তাদের দফতর পর্যন্ত পৌঁছায় না বলেও তিনি জানিয়েছেন। এদিকে শহরের বড় স্টেশন মোলহেডে মোহনা ডিঙ্গি মাঝি নামের এক সমিতির খোঁজ মিলল।
যারা সংশ্লিষ্টদের থেকে ইজারাবিহীনভাবে মোলহেডের জায়গা দখল করে ট্রলার ভ্রমণ পরিচালনা করছেন। যাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ৭২টি স্টিলবডি ট্রলার।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন মোহনা ডিঙ্গি মাঝি সমিতির সভাপতি মানছুর মোল্লা। তিনি জানান, সরকারি নিয়ম মেনে ট্রলার চালাতে প্রস্তুত তারা। তবে সে নিয়ম না জানায় দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এখানে সমিতির মাধ্যমে ট্রলার চালালেও সমিতিটি রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না।
তাই তারা সরকারি সব নিয়ম মানতে তাদের মোহনা ডিঙ্গি মাঝি সমিতিটি দ্রুত সংশ্লিষ্টদের কাছে রেজিস্ট্রেশন করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এভাবে চাঁদপুরের পুরানবাজার, হরিণা, আলুবাজার, মোহনপুরসহ বেশ কিছু স্থানে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে স্টিলবডি ট্রলার নদীতে চলাচল করছে। যাতে লাভবান হচ্ছে সিন্ডিকেট চক্র।
তবে মোলহেডে আসা সাধারণ ভ্রমণপিপাসুদের অভিযোগ, স্টিলবডি এসব টলার ঘণ্টাপ্রতি মাত্রাতিরিক্তভাবে ভাড়া নির্ধারণ করেছে। তারা তাদের নড়বড়ে ফিটনেসবিহীন ট্রলারে ৩০-৪০ জন করে যাত্রী বহন করছে।
অনেকে ট্রলার নিয়ে চলে যাচ্ছে পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মাঝামাঝি স্রোতেও। অথচ তাদের ট্রলারে নেই পর্যাপ্ত কোনো প্রকার নিরাপত্তা সরঞ্জাম। এমনকি নেই ট্রলার চালকদের তেমন কোনো প্রশিক্ষণও।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর নৌ থানার অফিসার ইনচার্জ জাহেদ হোসেন বলেন, আমরা মাঝে মাঝে এসব নৌযানে অভিযান চালিয়ে থাকি। তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি।
চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান জানান, আমরা স্টিলবডি ট্রলারগুলোকে মাঝ নদী বা স্রোতময় এলাকায় না যেতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করছি।
আমরা মোলহেডে লাইফ জ্যাকেট ও বেশ কিছু রিং বয়া স্টিলবডি ট্রলার চালকদের দিয়েছি। দরকার হলে আরও দিয়ে দেব।
করেসপন্ডেট,২৯ আগস্ট ২০২০