জেলা ছাড়িয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আলোচনায় যদি কাউকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়ে থাকে, তবে তিনি নিঃসন্দেহে চাঁদপুর পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার। একসময় তিনি ছিলেন একজন সাধারণ শিক্ষক, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্ষমতার লোভে নিজেকে পরিণত করেন এক প্রভাবশালী ভয়ঙ্কর ব্যক্তি হিসেবে। তার উত্থানের পেছনে মূল চালিকা শক্তি ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তার ছত্রছায়ায় রতন কুমার হয়ে ওঠেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অলিখিত উপদেষ্টা, যার ক্ষমতা ছিল বিশাল, আর প্রভাব ছিল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে।
রতন কুমারের ক্ষমতার উত্থান শুরু হয় ডা. দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর। তিনি দ্রুতই হয়ে ওঠেন দীপু মনির সবচেয়ে আস্থাভাজন ব্যক্তি। তার প্রভাব ছিল এতটাই বিস্তৃত যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তেই তার সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকত। বিশেষ করে, বদলি, নিয়োগ এবং পদোন্নতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তার ক্ষমতার দাপট ছিল অপ্রতিরোধ্য। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা পর্যন্ত রতন কুমারের কাছে ছুটে আসতেন নিজেদের জন্য সুবিধাজনক পদ কিংবা স্থানে বদলি পাওয়ার জন্য।
রতন কুমার মজুমদার শুধু বদলির বিষয়েই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তার ক্ষমতার অন্যতম বড় প্রমাণ মেলে ২০১৮ সালের এক ঘটনায়। চাঁদপুর মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাসুদুর রহমানকে ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে বর্তমান কারিকুলামের বিরোধিতা করায় খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। এই বদলির পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন রতন কুমার মজুমদার। এ ধরনের অন্যায় পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি স্থানীয় শিক্ষকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হন।
শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, রতন কুমার মজুমদার ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়ানোর মাধ্যমেও তার ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছিলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উসকানিমূলক পোস্ট দিতেন, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা তৈরি করত। ২০২০ সালে হেফাজত ইসলাম নেতা বাবু নগরীকে নিয়ে একটি আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়ার পর, হেফাজত নেতারা তার বিরুদ্ধে কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দেন। পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে ওঠে যে, ডা. দীপু মনির বড় ভাই ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপুকে মধ্যস্থতায় নামতে হয় এবং রতন কুমারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়।
এরপরেও রতন কুমারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেমে থাকেনি। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি, তিনি ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে কটূক্তি করেন। এর প্রতিবাদে পুরাণ বাজার কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধন করেন। রতন কুমার মজুমদার তার ক্ষমতা ব্যবহার করে সবসময়ই কোনোমতে রক্ষা পেয়ে যেতেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি মানুষের ক্ষোভ ক্রমাগত বেড়েছে।
রতন কুমার মজুমদারের ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার ঘটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়। এই আন্দোলন চলাকালীন, তিনি পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে একটি মানববন্ধনের নেতৃত্ব দেন, যেখানে তার সাথে দীপু মনির সুবিধাভোগী অন্য পেশার লোকদেরও জড়ো করা হয়। শিক্ষার্থীদের ক্রোধ তখন তীব্র হয়ে ওঠে, কারণ তারা এই মানববন্ধনের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে যা পরবর্তীতে রতন কুমারের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর আসে সেই মুহূর্ত, যা ছিল রতন কুমারের ক্ষমতার পতনের সূচনা। ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে, আর সেই সঙ্গে রতন কুমারও আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, ক্ষুব্ধ জনতা তার চাঁদপুর শহরের আদালত পাড়ার বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। তার দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত প্রভাব আর তাকে রক্ষা করতে পারেনি। শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবৈধ কর্মকাণ্ড এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে ওঠে।
অবশেষে, ৭ আগস্ট থেকে সেই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মো. শোয়ায়েব। তিনি ওই কলেজের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। রতন কুমার মজুমদারের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তারের কাহিনী আজও শিক্ষাব্যবস্থার অন্ধকার একটি অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার কিভাবে একজন মানুষকে পরিণত করে ত্রাসে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবেন রতন কুমার মজুমদার।
চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট, ১৭ আগস্ট ২০২৪