চাঁদপুর

চাঁদপুরে বধ্যভূমি যখন বিনোদন কেন্দ্র

চাঁদপুর দেশের অন্যতম নদীবন্দর ও ব্যবসাকর স্থান নামে প্রসিদ্ধ। নৌ, সড়ক,রেল পথে চাঁদপুরের সাথে রয়েছে দেশের সব জেলার সাথে একাট চমৎকার যোগাযোগ মাধ্যম । ১৯৭১ সালে চাঁদপুরে স্বাধীনতা যুদ্ধের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য । শিক্ষা,সংস্কৃতি ও সাহিত্যে রয়েছে সুখ্যাতি। আবার বিষাদের ঘটনাও রয়েছে । পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলনস্থলের চাঁদপুর শহরের বড়স্টেশন ‘মোলহেড’এলাকা একটি বধ্যভূমি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে শত শত মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করে লাশ নদীতে শিকল বা তার দিয়ে বেঁধে নৃশংসভাবে হত্যা করে ফেলে দেয়া হত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় শহীদদের রক্তমাখা এ স্থানটির ভাবগাম্ভীর্জতা ও পবিত্রতা রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া বিষয়টি দেখছি না। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এর ইতিহাসও জানেনা । মোলহেড এলাকায় বিভিন্ন সময় হয়েছে মেলা,উৎসব, নাচ-গান । কোনো কোনো সময় সামাজিক কর্মকান্ডের কথাও শুনছি ।

ইতিহাসে এর তেমন কোনো তথ্য ও উপাত্ত বিস্তারিত লেখার ব্যবস্থা না করায় বা না থাকলেও এ স্থানটিকে জেলা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আশা পর্যটকরা জানেন এটি একটি নৈসর্গিক বিনোদনকেন্দ্র তথা পর্যটন স্পট । বর্তমান তরুণ-তরুণীদের কাছে এটি ডেটিং স্পট । এ স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘রক্তধারা’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করলেও বেশিরভাগ মানুষই এটিকে পর্যটন স্পটের একটি অংশ মনে করেন।

বধ্যভূমি বড়স্টেশন মোলহেড এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়। সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাগলের পাল। রক্তধারার পাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বিপুল সংখ্যক দোকান-পাট। রক্তধারার থাকে বিভিন্ন সাইনবোর্ডে বা টানানো পোস্টার। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তিন নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে মানুষজন আসেন । আছে ভিক্ষুকের যন্ত্রণা প্রবল।

চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক)ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদল্লাহ-আল -মাহমুদ জামান এর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত । তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২০।

মোলহেডে ঘুরতে আসা ক’জন বলেন, আমরা স্থানীয় হলেও জানতাম না এটি একটি বধ্যভূমি। আমরা ছোটবেলা থেকেই এটিকে একটি বিনোদন বা ঘোরাঘুরির জায়গা হিসেবেই জেনে এসেছি। যখনই ভালো লাগে না তখনই একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য এখানে ঘুরতে আসি।

গুগলে সার্চ দিয়ে দেখা গেছে – চাঁদপুরে ঘোরার মতো প্রধান জায়গা এটি। সে হিসেবে এখানে বন্ধুরা সবাই ঘুরতে এসেছি। আমরা কেউই জানি না- এটি একটি বধ্যভূমি। এটি যদি বধ্যভূমি হয়েই থাকে তাহলে এর ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ রক্ষায় সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত জেলা ব্র্যান্ডিং বইটিতেও এই বধ্যভূমিকে নৈসর্গিক বিনোদনের স্থান হিসেবে গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে-চাঁদপুর বড় স্টেশনের পশ্চিম পাশে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত ত্রি-কোণাকার অংশটিই মোলহেড নামে পরিচিত। এ স্থান হতে পশ্চিম দিগন্তে খুব স্পষ্টভাবে সূর্যাস্ত দেখা যায়। ইংরেজি শব্দ ‘ মোলহেড মানে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ অভিঘাত হতে স্থল ভূমিকে রক্ষার জন্য পাথর বা কংক্রিট দ্বারা নির্মিত শক্ত প্রাচীর বা বাঁধ।’।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলিত প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণি হতে চাঁদপুর শহরকে রক্ষার জন্য বোল্ডার দ্বারা এটি নির্মিত হয়।
নদীভাঙ্গনের তীব্রতার সময় পানি বোর্ডে জনৈক একজন প্রকৌশলী এ জায়গার গভীরতা সম্পর্কে বলেন,‘২৫ তলা একটি ভবনের সমান হবে এর গভীরত্।া প্রতিসেকেন্ডে ৬৫ হাজার কিউবেক পানি মোলহেড দিয়ে পাশ কাটিয়ে ভাটিতে চলে যায়। একসময় মোলহেড থেকে ২৩ কি.মি উত্তরে এখলাছপুর নামক স্থানে পদ্মা মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে।

বছরে একবার নাকি স্রোতধারা উল্টোদিকে প্রবাতিহ হত। অন্য দিকে মেঘনার উৎপত্তি হলো হিমালয় পর্বত। ঐ স্থান দিয়ে সরুভাবে বরফগলা পানি ও বৃষ্টির পানি ফুলছোঁয়া নামক স্থান দিয়ে টিপাইনদী নাম ধারণ করে বরাকনদীতে পরিণত হয়েছে। যা বাংলাদেশের ১ম কি.মি,উত্তরে । প্রতিদিনই সূর্যাস্তের একটি দৃশ্য দেখারমত ।

বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর দু’টো নদী হয়ে একটি হয় কুশিয়ারা অপরটি হলো সুরমা । কুশিয়ারা নদী দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে ঈশ্বরদি নামক স্থানে মেঘনানদী নাম ধারন করে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুর কে বর্তমানে বামতীরে রেখে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।

এদিকে পদ্মা ,বুড়িগঙ্গা,মেঘনাধনাগোদা নদীর পানিসহ ছোট-বড় ২০টির অধিক নদ-নদীর পানি এ মেঘনানদী দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হচ্ছে । এসব কারণে ও অতিবৃষ্টির পানির তীব্র আকারে চাঁদপুর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে ভয়ংকর ঘূর্ণিস্রোতের সৃষ্টি হয় বর্ষা মৌসুমে।

বর্ষায় ডাকাতিয়ার স্রোত ও ক পদ্মা ,বুড়িগঙ্গা,মেঘনাধনাগোদা নদীর পানিসহ ছোট-বড় ২০টির অধিক নদ-নদীর পানি এ মেঘনানদী দিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত উত্তর-পশ্চিম-পূর্ব দিক থেকে প্রবলবেগে ধেয়ে আসার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। যার ফলে বিকল্প একটি নৌ-টারমিনালও বানাতে হয়েছে জলযান গুলোকে নিরাপদভাবে চলাচর করতে সহায়তা করছে। দৈনিক ৩ বার পানির রেকর্ড রাখতে হয় পানি বোর্ডের।

শুষ্ক মৌসুমে স্থানীয়রা আবিস্কার করে ফেলল মেঘনা পশ্চিম তীরে মিনি কক্সবার্জা। চলমান সময়েই শুরু হবে এটির যাত্রা। দৈনিক ১০০-১৫০ ছোট ছোট ট্রলার এপার-ওপার আসা-যাওয়া করে থাকে। এ সব কারণেও এর গুরুত্ব ও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

জেলা ব্র্যান্ডিং কমিটির ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ বই থেকে জানা যায়,স্থাপিত রক্তধারার পরিচিতিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর শহরের পশ্চিম প্রান্তে মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় পুরানবাজার এবং বড় স্টেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কয়েকটি নির্যাতন কেন্দ্র বা টর্চার সেল স্থাপন করে।

নৌকা-লঞ্চ-স্টিমার ও রেলগাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে যারা চাঁদপুরে পৌঁছাতো, সন্দেহ হলে তাদেরকে এবং জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে স্বাধীনতার পক্ষের লোক ও নারীদের এ টর্চার সেলে এনে নির্যাতন করে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত, অর্ধ-মৃত অথবা হত্যা করে মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর খরস্রোতে ফেলে দেয়া হতো।

পাক হানাদার বাহিনীর এদেশীয় দোসররা এ হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করতো। পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার শিকার শহীদদের স্মরণে ২০১১ সালে মোলহেডের সন্নিকটে নির্মিত হলো স্মৃতিসৌধ এ ‘রক্তধারা’। এ স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চাঁদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছথেকে জানা যায় – বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে এ বধ্যভূমিতে আনুমানিক তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের অনেকেই হাত-পা বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।

মানুষ ঘুরবে, নদীর দৃশ্য দেখবে, রক্তধারাটাও দেখবে। এ থেকে যার যেমন অনুভূতি হয়। সব মানুষতো আর এক রকম না। সবাইকেতো আর পাহারা দেয়া সম্ভব না। এখানে প্রবেশের একটি নির্দিষ্ট সময় থাকবে। স্থানটিতে যাচ্ছে-তাই যেন না হয়,সেদিকে নজর রাখতে হবে। যা করা হবে তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই করতে হবে। এখানকার ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ রক্ষায় আমরা বসবো, কাজ করবো।

চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বলেন, ‘ বড়স্টেশন মোলহেড বধ্যভূমির প্রতীক হিসেবে রক্তধারা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখানে অশ্লীলতা যদি কিছু হয়, সেটি দেখার বিষয় । কিন্তু সুস্থ বিনোদন তথা মানুষ যাবে ঘুরবে সেটিতো সাংঘর্ষিক না।’

তিনি বলেন, গান-বাজনা, নাচ-গানতো শহীদ মিনারেও হয়। তারপরও স্মৃতিফলক করা যেতে পারে। কারা কারা মারা গিয়েছিল,কি হয়েছিল-এখানে আগতরা এসব বিষয়ে পড়ে জানতে পারবেন। সমস্যা হচ্ছে-আমরা করতে চাইলে সেটি একটু কঠিন। এ জায়গাটি হচ্ছে রেলওয়ের। এর ব্যবস্থাপনায় পৌরসভা ও জেলা প্রশাসন। এ তিনটি গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে জানান তিনি।

প্রতিবেদক :  আবদুল গনি, ১৫ ডিসেম্বের ২০২০ ।

Share