Home / চাঁদপুর / চাঁদপুরে দলিত জনগোষ্ঠী মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত
চাঁদপুরে দলিত জনগোষ্ঠী মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত

চাঁদপুরে দলিত জনগোষ্ঠী মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত

চাঁদপুরে দলিত জনগোষ্ঠী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে বলে তাদের নেতাদের সাথে পর্যালোচনা করে মতামতের ভিত্তিতে জানা যায়। যার ফলে চাঁদপুরে কয়েক হাজার দলিত সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীরা এক হচ্ছে তাদের অধিকার ফিরে পেতে। তারা এক ও অভিন্ন বলে মত প্রকাশ করেন।

দলিতরা বহু বছর পরে হলেও সেই ২’শ বছর পূর্বের আধি পুরুষের আদর্শ লালন করে একটি পতাকাতলে এসে নিজেদের অধিকার রক্ষার চেষ্টায় জাগ্রত হয়েছে। এরা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে একটি গোষ্ঠী তাদের সামনে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে তারা পিছিয়ে যান জীবন রক্ষার্থে। এমনটি বললেন, দলিত জনগোষ্ঠীর নেতারা। তবু তারা আর পিছু হঠতে চান না। এবার তাদের এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। তারা তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সকল প্রকার মোকাবেলা করতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে অধিকাংশই মত প্রকাশ করেন। এদের প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা ও সু-দৃষ্টি। তাদের এক নেতাকে পৌর কর্তৃপক্ষ হঠাৎ বাসস্থান থেকে সম্প্রতি উচ্ছেদ ও চাকুরি থেকে অবসরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তারা তাদের উপদেষ্টার কথা মত সকলে এক হয়ে আন্দোলনে রূপ সৃষ্টি করে। এতে করে পৌর কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে নন্দ কিশোর হরিজনকে পুনরায় চাকুরীতে বহাল রাখে এবং বাসস্থান ফিরিয়ে দেন। এ দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার সুযোগ পেয়ে তারা এখন সোচ্ছার হয়েছেন। তারা তাদের অধিকারের জন্য এক অভিন্ন বলে মত প্রকাশ করছেন এবং যে কোন কাজে সকলে এক হয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

শহরের স্বর্ণখোলা হরিজন কলোনীর নেতা ও চাঁদপুর পৌরসভার সুইপার সুপারভাইজার নন্দকিশোর হরিজন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে বলেন, চাঁদপুরে দলিত হরিজনদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিক্ষণেই। তারা প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে এবং হচ্ছে বলেও জানান।

স্বর্ণখোলা হরিজন কলোনীতে ৭০টি দলিত হরিজন পরিবারের ৫’শ লোকের বসবাস। এ কলোনীতে একই ঘরে কয়েকটি পরিবার বসবাস করাই মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘন। এরা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এসব ক্ষেত্রে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রয়েছে। নিজেদের উপার্জনের বাহিরে সরকারি কোন সাহায্য তারা পায় না বলে জানান। পৌরসভার চাকুরি করছে বলে বাসস্থান পাচ্ছে। চাকুরি নাই তো বাসস্থান নাই। এদের জন্য স্থায়ী বাসস্থান চায় তারা। শিক্ষা অর্জন করতে হয় নিজেদের অর্থে। সরকারিভাবে তাদের জন্য কোনো ভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। এদের ভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন বলে তারা মত প্রকাশ করেন। দলিত হরিজন শিশুদের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের শিশুরা মিশতে চায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এজন্য তারা বৈষম্যের স্বীকার।

পৌর কর্তৃপক্ষ পুরান বাজার নতুন বাজারে দুই শিফটে ২০ জন করে ৪০ জন প্রতিদিন হাজিরায় কাজ করে। প্রতিদিনের কাজের জন্য পায় মাত্র ৩০ টাকা। কাজে উপস্থিত নাই তো হাজিরা নাই। পৌরসভায় কাজ না করলে বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হবে বলেও পৌর কর্তৃপক্ষের ঘোষণা। যারা গাড়ি দিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করে তারা প্রতিদিন হাজিরা পায় ১’শ টাকা। নন্দ কিশোর হরিজন পৌরসভায় সুইপার সুপার ভাইজার হিসেবে ভোর ৫ টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাজ করে ২’শ টাকা হাজিরা পান বলে জানান।

চাঁদপুর পৌরসভায় অস্থায়ী ভিত্তিতে নতুন বাজার পুরান বাজারের জন্য ২’শ সুইপার রয়েছে। এদের জন্য মাসিক বেতন মাত্র ৯’শ টাকা। এখানে কোনো স্থায়ী সুইপার নিয়োগ নাই।

চাঁদপুর শহরের বড় ষ্টেশন রেলওয়ে হরিজন কলোনীর শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ মন্দিরের কোষাধ্যক্ষ বিধান চন্দ্র হরিজন জানান, বর্তমান ডিজিটাল যুগে হরিজনরা এখনও অনেক পিছিয়ে। দেখা যায়, শিক্ষা দিক্ষা অর্জন করেও ভাল অবস্থানে পৌছতে গেলে হরিজনদের মানবিক দিক থেকে বাঁধাগ্রস্ত হতে হয়। প্রথমত মানবাধিকার বৈষম্যের কাছে বাধাগ্রস্ত। দলিত হরিজন জনগোষ্ঠী ভালো শিক্ষা অর্জন করেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো ক্ষেত্রেই জীবন যাপনে প্রথম সারিতে আসতে পারছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে, বৈষম্য ও মানবাধিকারের কাছেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তারা। সংবিধান অনুযায়ী খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সবই নিজেদের যোগ্যতার বলে নিজেই বরণ পোষণ করছে তারা। সরকারিভাবে চাঁদপুরে হরিজনরা কোন সহযোগিতা পাচ্ছে না। নারীদের ক্ষেত্রে নারীরা পূর্বের মত সুন্দরভাবে সামাজিকভাবে জীবন যাপন করতে চায়। কিন্তু দায়িত্ব ভাগ্য তাদের এমনই সমাজ আজও তাদের কোনো রূপ অধিকার দিচ্ছে না বলে হরিজনরা জানান। রেলওয়ে হরিজন কলোনীর বিধবা ও বয়স্করা সঠিকভাবে বিধবা ভাতা পাচ্ছে না। এখানে বিধবা ও বয়স্ক যে পরিমাণে রয়েছে সে পরিমাণ সহযোগিতা স্থানীয় কাউন্সিলর করছে না। কর্মসংস্থান ও সামাজিক উন্নয়নে নারীদের এখনও এখানে এগিয়ে যেতে পারছে না। তারা মানবিক ও বৈষম্যের স্বীকারের জালে বন্দি রয়েছে। নতুন বাজার মুচি বাড়ির রবি দাস সম্প্রদায়ের নেতা নারায়ণ চন্দ্র রবি দাস জানান, তারা কিছুই পাচ্ছে না। সব ক্ষেত্রেই তাদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সুইপারদের জন্য ৮০% চাকুরীর কোটা রয়েছে। তারা সে পরিমাণ চাকুরী পাচ্ছে না। অন্য সম্পাদায়ের লোকেরা এসব চাকুরীতে নিয়োজিত হচ্ছে। রবি দাস সম্প্রদায়ের জন্য যে কোঠা আছে সে পরিমাণ কোটার চাকুরি তারা পাচ্ছে না। কবলা সু মেকার পদটি বিডিআর, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও স্বাস্থ্য বিভাগের হাসপাতালে রয়েছে। কিন্তু সেখানে তাদেরকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলে তারা জানান।

ব্রিটিশ শাসন আমলে তাদের জন্য এ আইনের প্রচলন করে গিয়েছিলেন। যোগ্যতা থাকলেও টাকার জন্য তারা চাকুরি পাচ্ছে না। টাকা নাই তো চাকুরী নাই, টাকা আছে তো চাকুরি আছে। চাকুরির ইন্টারভিউ দিয়ে টিকলেও অর্থের জন্য তাদেরকে চাকুরি দেওয়া হচ্ছে না।

গত কয়েক মাস পূর্বে তাদের এ কলোনী থেকে পুলিশ বিভাগে চাকুরি দেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিল ৩ যুবক। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রতি জনের ৩ লাখ টাকার জন্য চাকুরি পায় না তারা। সরকারি সহযোগিতা চায় রবি দাস সম্প্রদায়ের এরা। এসএসসি পাস করেও অনেক শিক্ষার্থী অর্থের জন্য কলেজে ভর্তি হয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পারছে না।

চাঁদপুরে রবি দাস সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি পুরোপুরি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সদর উপজেলা লক্ষ্মীপুর আশ্রয় প্রকল্পে বাসস্থানের জন্য এ কলোনীর ২৫ জন দরখাস্ত করেছিল। কাউকেই অর্থ বিহীন আশ্রম প্রকল্পে ঘর দেওয়া হয়নি। একজনকে দেওয়া হয়েছে তাও টাকার বিনিময়ে। আশ্রায়ণ প্রকল্পের দায়িত্ব থাকা কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছা মত বাসস্থান দিচ্ছে এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে। যারা প্রকৃত পক্ষে আশ্রায়ণ প্রকল্পে বাসস্থান পাওয়ার যোগ্য তাদেরকে বাসস্থান না দিয়ে অর্থশালী ব্যক্তিদের কাছে বাসস্থান বিক্রি করা হচ্ছে। এখানে ৩০ জন বিধবা বয়স্ক থাকলেও ভাতা পাচ্ছে মাত্র ১০ জন। বাকী ২০ জন বিধবা ও বয়স্ক ভাতা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তারা অর্থের জন্য অসুস্থ্য হয়েও ভাল ডাক্তার দেখাতে পারেনা। সরকারি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চিকিৎসা পাচ্ছে না।

চাঁদপুরের রবি দাসদের জন্য ভিন্ন কোনো শ্মশান নেই। তাদেরকে রাস্তার পাশে যেখানে সেখানে মৃত্যুর পর সমাধিত করা হচ্ছে।

তাদের দাবি, চাঁদপুরের জেলায় ও উপজেলায় তাদের জন্য সরকারিভাবে শ্মশানের ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। যেন মৃত্যুর পর তাদেরকে সমাহিত করা যায়।

||আপডেট: ০৮:০২ অপরাহ্ন, ১৪ মার্চ ২০১৬, সোমবার

এমআরআর