চাঁদপুর

চাঁদপুরে খুন-খারাবি বৃদ্ধি : সাধারণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

চাঁদপুরে সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বেড়েছে উদ্বেগ-উকণ্ঠা। এমন পরিস্থিতে কেউ যেনো নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। পান থেকে চুন খসলেই যেনো খুন খারাবি প্রাত্যাহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন হাতে তুলে নিতে দুর্বৃত্তদের যেনো বুক কাঁপছে না। সামান্য অর্থনৈতিক লেনদেন কিংবা আধিপত্য বিস্তারে এক অন্যের ওপর অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মারধর ও হত্যাকা-ের পর দুর্বৃত্তরা বীরদর্পে ঘটনাস্থল থেকে সরে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী সত্যি পেরে ওঠছে না, নাকি সন্ত্রাসীদের তল্পিতল্পাবাহী হচ্ছে এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

কেউ কেউ বলছেন চাঁদপুর জেলার স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘোলাটে করতেই একটি চিহ্নিতমহল তৎপর হয়ে উঠছে। যার কারণে হঠাৎ করেই চাঁদপুরে হত্যাকা-সহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধগুলো ক্রমাম্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই বলছেন মাদকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নজরদারী বৃদ্ধির কারণে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতেই পরিকল্পিতভাবেই অপরাধ সংগঠিত করছে সংঘবদ্ধ চক্র।

চাঁদপুরের বিদায়ী পুলিশ সুপার আমির জাফর ৬ মাস আগে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করলে চাঁদপুরে প্রথমবারের মত নারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন শামসুন্নাহার। তিনি চাঁদপুরে দায়িত্ব গ্রহণের পর স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এছাড়া জেলা পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে ব্যাপক রদবদলও হয়। ফলে জেলায় মাদক বিরোধী অভিযানে ব্যাপক সাফল্য আসে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জানায়।

আর এ কারণেই অভিযোগ উঠেছে মাদক আমদানির মূল হোতারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটক না হলেও বহনকারীরা ব্যাপকহারে আটক হওয়াতেই অনেকটা বেকায়দায় পরে মূল হোতারা। ফলে তাদেরই কোনো অংশ কিংবা সুবিধাভোগী কোনো মহল বর্তমানে জেলার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই পরিকল্পিত অপরাধ সংগঠিত করছে বলে চাউর রয়েছে।

তবে এসবের কোনোটির সাথে একমত নয় জেলা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তারা বলছেন, ধারাবাহিক কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতই সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। আর অপরাধীদের দ্রুত আইনে আওতায় আনতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর রয়েছে বলে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার চাঁদপুর টাইমসকে জানান। তার মতে কে কী বলছে তা নিয়ে ভাবছে না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বরং অপরাধীদের চিহ্নিত করতেই কাজ করছেন তারা।

চাঁদপুরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন মহলের অভিমত, গত ক’বছর ধরে জেলায় দেশীয় অস্ত্রের মহড়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও বর্তমানে তা সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক তৎপরতা কম থাকায় দেশীয় অস্ত্রের মহড়াও কমে এসেছে বলে তারা মনে করেন। তবে উদ্বেগ নিয়েই অনেকে বলছেন চাঞ্চল্যকর হত্যকাণ্ডসহ পরিকল্পিত হত্যার চেষ্টা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।

এসব অপরাধ সংগঠনে চিহ্নিত কোনোমহল জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে তাদের অভিমত। তাদের দাবি গত ৭ নভেম্বর দিবাগত রাত ১১টায় চট্টগ্রাম সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. শামীম শেখকে হাত-পায়ের রগ কেটে, ছুরিকাঘাত করে দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে চাঁদপুর সেতুর ওপর থেকে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দেয়া হয়। যা পরিকল্পিত হত্যার চেষ্টা বলে দাবি করেন সচেতন মহল।

অপরদিকে ৯ নভেম্বর গভীর রাতে চাঁদপুর সদর উপজেলার আশিকাটি ইউনিয়নের সেনগাঁও গ্রামের পাটোয়ারী বাড়িতে চোর সন্দেহে মোস্তফা গাজী নামের এক কাঠমিস্ত্রিকে পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ হত্যাকাণ্ডটি অনেকটাই পরিকল্পিত বলে দাবি করছেন মৃত মোস্তফা গাজীর পরিবার। কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা বলছেন, চোর সন্দেহে গণপিটুনি দিলে যে পরিমাণ বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের উপস্থিতি দরকার তা ছিলো না।

তাদের দাবির সাথে অনেকটাই একমত পোষণ করে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার চাঁদপুর টাইমসকে জানান, এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। তবে তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কী-না। এছাড়া প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে গরু চুরিকে কেন্দ্র করে’ই এ ঘটনা সংগঠিত হয়।

এছাড়া একই দিন মতলব উত্তরে এক অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ ঘটনা নিয়েও স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। নিহত গৃহবধূ ফারজানা এখলাছপুর গ্রামের সোহেলের স্ত্রী। ৮ মাস আগে প্রেমের টানে তারা পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

এছাড়াও বিচ্ছিন্ন কিংবা সাধারণ অপরাধের মতো গত ৩১ আক্টোবর রাত সাড়ে ৭টায় মতলব উত্তর ফরাজীকান্দি ইউনিয়নের বড় হালদিয়া গ্রামের ধান ক্ষেত থেকে অজ্ঞাত যুবতীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৬ অক্টোবর কচুয়ায় পান্না বেগম নামের গৃহবধূকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়। ১৭ অক্টোবর ফরিদগঞ্জে সম্পত্তিগত বিরোধ কেন্দ্র করে হান্নান শেখ নামের এক ঠিকাদারকে পিটিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষরা। ঐ দিনই ইসমাইল নামের এক জেলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

ধারাবাহিকভাবেই ১৩ অক্টোবর সদর উপজেলার মৈশাদীতে ২ সন্তানের জননীর আত্মহত্যা করা খবর পাওয়া যায়। ৭ অক্টোবর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আশিকাটি ইউনিয়নের শরীফ আত্মহত্যা করে। ১২ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর শহরের যমুনা রোডে মুন্নী আক্তার নামের এক কিশোরীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ৮ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত এক যুবক ২০ দিন পরে মারা যায়। ৬ সেপ্টেম্বর ফরিদগঞ্জে দুর্বৃত্তরা দা দিয়ে কুপিয়ে আলিমেরনেছা নামে এক বৃদ্ধাকে খুন করে।

তবে ২২ আগস্ট চাঁদপুর শহরের রহমতপুর আবাসিক এলাকায় চাঞ্চল্যকর একটি খুনের ঘটনা ঘটে। ওইদিন রাত ৮টায় টাকা দেনা-পাওয়া কেন্দ্র করে প্রবাসীর স্ত্রী কোহিনুর বেগমকে ডেকে নিয়ে আরেক মহিলা নয়ন বেগম দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। যা নিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

একের পর এক লোমহর্ষক হত্যাকা-ের ঘটনা বৃদ্ধিতে জেলার সর্বত্র ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সচেতন মহল দাবি করে আসছে। লোমহর্ষক হত্যাকা- ও হত্যা চেষ্টার ঘটনা বৃদ্ধিকে তারা সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ বলে দাবি করে আসছেন।

এ বিষয়ে পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার চাঁদপুর টাইমসকে জানান, চাঁদপুরের আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা ধারাবাহিক যেসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে তা নিয়মিত অপরাধ মাত্র। পারিবারিক কলহ কিংবা দেনা-পাওনা কেন্দ্র করেই এসব অপরাধগুলো হচ্ছে।

তবে মাদকের সিন্ডিকেট কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠী আইন-শৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা করছে না বলে দৃঢ়তার সাথেই দাবি করেন পুলিশ সুপার।

সচেতন মহলের দাবি প্রসঙ্গে তিনি জানান, কে কী বলছে তা নিয়ে কিছুই বলার নেই। বরং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি ঘটনাই তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে তৎপর রয়েছে।

রেজাউল করিম

 

||আপডেট: ০৬:১১ পিএম, ১১ নভেম্বর ২০১৫, বুধবার

এমআরআর

Share