চাঁদপুর

চাঁদপুরে কালবৈশাখি ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি : অন্ধকারে গ্রামাঞ্চল

টানা উত্তাপের পর আচমকা ১ মে রোববার সন্ধ্যায় কালবৈশাখি ঝড়ে চাঁদপুরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হঠাৎ বয়ে যাওয়া দ্রুতগামি ঝড়ো হাওয়ার শুরুতে রাস্তাঘাটে ধুলাবালি উড়তে থাকে। মুহুর্তের মধ্যে সড়কে থাকা লোকজন নিরাপদে সরে যাওয়া ও দোকান পাট বন্ধ করার পুর্বেই শুরু হয় প্রচন্ড বজ্রসহ বৃষ্টি।

চাঁদপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে রোববার সন্ধ্যায় জেলায় ১৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

এসময় চাঁদপুর জেলা ও শহরের বিভিন্ন স্থানে নানা ক্ষয় ক্ষতির খবর পাওয়া যায়। শহরের বড় স্টেশন লঞ্চ টার্মিনাল ঘাট সংলগ্ন টিলা বাড়ি এলাকার নুরানী মক্তবের ভবনটি মুহূর্তের মধ্যেই ঘূর্নিবাতাসে গাছ ও বসত ঘরের ওপর আছড়ে পড়ে।

তবে ওই সময় ঘরটির আশেপাশে লোকজন না থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

একই সময়ে কাল বৈশাখির ঝড়ে ডাকাতিয়া নদীতে ভুইয়ারঘাট এলাকায় মালামালসহ ৪ টি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটেছে । ডুবে যাওয়া ট্রলারগুলো হলো ফরিদপুরের মঞ্জু মাঝির এমভি ভাটিলক্ষীপুর, নুরুজ্জামান মাঝির আল মিরাজ, কুদ্দুস মাঝির সিলেটি ট্রলার ও চাঁদপুরের আনিস-স্বপন পরিবহন।

৪টি ট্রলারে প্রায় ২ কোটি টাকার মালামাল ছিলো বলে জানান ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা।

এদিকে কোড়ালিয়া পশ্চিম বিষ্ণুদী এলাকায় মাতাব্বর বাড়ি সড়কের উপড় বড় সেগুন গাছ ভেঙ্গে পাশ্ববর্তি ভবনের উপর পরে।

এ সময় সড়কের পাশে পিডিবির বিদ্যুৎ খুটির ৩৩ হাজার ভোল্টের মেইন তার ছিড়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। যার ফলে পাশ্ববর্তী এলাকায় ওই দিন সন্ধ্যার পর থেকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এলাকাটি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিলো।

শহরের গুয়াখোলা এলাকায় নির্মাণাধিন বহুতল ভবনের ওপর থেকে বাতাসের তোড়ে দেয়াল ধসে রাস্তার উপর পড়ে যায়।

নতুন আলিম পাড়া এলাকার সিএসডি খাদ্য গুদাম সংলগ্ন কৃষ্ণচুড়া গাছ কালবৈশাখির ঝড়ে উপড়ে বিদ্যুতের তারে পড়লে এ এলাকায়ও বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ঝড়ো হাওয়ার সময় তাৎক্ষনিক মুহূর্তে সড়কের ওপর থাকা সিএনজি স্কুটার, অটো রিক্সা, রিক্সাসহ কয়েকটি যানবাহন উপড়ে যায়। এ সময় বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে।

চাঁদপুর রায়পুর সড়কের গাছতলা এলাকা থেকে শুরু করে বাগাদি চৌরাস্তা পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সড়কের পাশে থাকা বেশ কয়েকটি টিনসেড নতুন ঘরের চাল বাতাসে উড়িয়ে পাশে থাকা গাছের উপর নিয়ে ফেলে। সড়কের পাশে থাকা বন বিভাগের বেশ কিছু গাছ উপড়ে রাস্তার উপর পড়ে যায়। এতে করে এ রাস্তায় যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটে। সকালে স্থানীয়রা এসব গাছের ঢালপালা ছেটে রাস্তার উপর থেকে গাছ সড়িয়ে যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দেয়।

শুধু এ সড়কেই নয় চাঁদপুর কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাড়কের কুমারডুগি থেকে শুরু করে হাজীগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ঝড়ের তান্ডবে গাছপালা উপড়ে, বাড়িঘর, দোকান পাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

অন্যান্য উপজেলায়ও ঝড়ের তান্ডবে একই রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে উপজেলা সুত্রে জানাযায়।

চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতাল সুত্রে জানাযায়, ঝড়ের পরবর্তী মুহূর্তে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন আহত অবস্থায় প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। এদের মধ্যে অনেকে ভর্তি রয়েছে। বিভিন্ন উপজেলাতেও বেশ কিছু আহতের খবর পাওয়া যায়।

সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে বলে জানা যায়। এদিকে ঝড়ের সময় নদীতে থাকা ইলিশ আহরণকারি জেলে নৌকা গুলো ঝড়ের কবলে পরে কোনরকম প্রানে বেঁচে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে আশে।

এ সময় নদীতে থাকা চাঁদপুর-ঢাকাগামি যাত্রীবাহি লঞ্চ এমভি সোনার তরী চালকের দক্ষতায় মুন্সিগঞ্জ ঘাটে ভিড়িয়ে প্রায় ৫শত যাত্রী প্রাণে রক্ষা পায়। কাল বৈশাখির ঝড়ে ধান, ভুট্রা সহ বিভিন্ন গাছের ফল ফলাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আমাদের হাজীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ঝড়ো ও অতিবৃষ্টিতে হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়কে গাছ ওপড়ে পড়ে যানচলাচলের বিঘœ ঘটেছে। হাজীগঞ্জ উপজেলার রান্ধুনীমুড়া গ্রামে নাজমুন নাহার নামের এক গৃহীনীর বসত ঘরে ভেঙ্গে গেছে।

প্রায় আধা ঘন্টা ব্যাপী বয়ে যাওয়া এই ঝড়ে বেশ কিছু বসতঘর, স্কুল-মাদরাসা সমূহের টিনে নির্মিত শ্রেনী কক্ষ, ইরি-বোর ধান, ভূট্টাসহ মৌসুমী ফসল, সেচ পাম্পের মেশিন ঘর ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

হাজীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ ১ এর আওতায় আনুমানিক শতাধিক বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙ্গে পড়েছে বলে জেনারেল ম্যানেজার নিশ্চিত করেছেন।

সরজমিনে সোমবার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় টিনের নির্মিত বসতঘর. বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুম, ইরি-বোরো, ভূট্টা মৌসুমী ফসলসহ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানাযায়, উপজেলার বাকিলা ইউনিয়নের বাকিলা গ্রামের মৃত সলেমানের ছেলে হারুনের চৌ-চালা টিনসেট বসত ঘরে রেইনট্রি গাছ পড়ে ঘর ভেঙ্গে পড়ে। বাকিলা ফাজিল মাদরাসার লম্বা দু’চালা ক্লাসরুমের চাল উড়িয়ে নিয়ে যায়। ১নং রাজারগাঁও ইউনিয়নের মেনাপুর পীর বাদশা মিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শ্রেণি কক্ষের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝড়ে।

উপজেলার ৩নং কালোচোঁ উত্তর ইউনিয়নের রাজাপুর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার ১ম ও ১০ শ্রেণি ব্যাতিত বাকী ক্লাসগুলোর দু’চালা ঘরের পুরো ভবন ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে অন্যত্র ফেলে। আগামী কর্মদিবসে কোন ভাবেই মাদ্রাসায় ক্লাস নেয়া সম্ভব হবে না। একই এলাকার সাহেব বাজার দক্ষিণ মাঠে বিদ্যুৎ সঞ্চালন মূল লাইনের প্রায় ৫টি স্টীলের পিলার ভেঙ্গে ফসলি মাঠে পড়ে যায়। এতে ফসলহানি ঘটে।

একই এলাকার পাশ্ববর্তী ওঁড়পুর গ্রামের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের পিলার ঝড়ে ভেঙ্গে বলাখাল-মতলব সড়কে পড়ে রয়েছে। রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার দুপুর ২টার মধ্যে উপজেলার পৌর এলাকা ব্যাতীত কোথায় বিদ্যুৎ বিতরণের স্বাভাবিকের খবর পাওয়া যায়নি।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি- ১ এর জেনারেল ম্যানেজার মো. ইউসুফ বলেন, যেসব লাইনে বড় ক্ষতি হয়েছে সেগুলো ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করাতে হবে। ছোট-খাটো কাজ গুলো শেষ করে লাইন স্বাভাবিক করতে ২দিন সময় লেগে যেতে পারে। আমরা যথাসম্ভব দ্রুত লাইন দেয়ার চেষ্টা করছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুর্শিদুল ইসলাম জানান ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপণ করে ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারগুলোকে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা চেষ্টা করব। এ ব্যাপারে উপজেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন কর্মকর্তাকে তালিকা তৈরী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা এসএম মিরাজ মুন্সী বলেন, ধমকা হাওয়ায় সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরা মানুষগুলো যান বাহনের ভোগান্তিতে পড়ে। হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়কের আল-আকবর একাডেমীর সামনে, টোলঘর নামক স্থানে গাছ পড়ে সড়কে যানবাহনের বিঘœতা সৃষ্টি হয়।

এদিকে কচুয়া উপজেলার বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, খাজুরিয়া-লক্ষীপুর সড়কের মুড়াগাঁও বাজারের বাজারের শতবর্ষী বটগাছটি একটি ফার্মেসীতে উপড়ে পড়েছে। একই গ্রামের বাহার বাড়ীর সেলিম, আরিফ ও ইব্রাহীমের বসতঘর, শাহীনের বসত ঘর, মজুমদার বাড়ীর জামাল হোসেন ও ইউছুফের বসতঘর ভেঙ্গে গেছে।

একই উপজেলার বাতাবাড়িয়া নুরুল আজাদ কলেজের একাডেমিক ভবনের একাংশে ঝড়ের কবলে বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। ঘুর্ণিঝড়ে ভবনটি লন্ড ভন্ড হয়ে পড়ে আছে। যেন দেখার কেউ নেই। গত এক দশক ধরেই ভবনটি ব্যবহারের অনুপযুক্ত ছিল।

শাহরাস্তি উপজেলার উয়ারুক বাজার হইতে মুড়াগাঁও-লক্ষীপুর সড়কে গাছ উপড়ে পড়ে যানচলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পথচারী মঞ্জুর আহমেদ সেলিম। তিনি আরো জানান, সন্ধ্যার পর থেকে হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি-কচুয়া উপজেলার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ ছিল।

চাঁদপুর আবহাওয়া অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষক আজহারুল ইসলাম জানান, রবিবার চাঁদপুরে সর্ব্বোচ্চ ৩৫.৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল। সর্বনিম্ম তাপমাত্রা ছিল ২৭.৩ ডিগ্রি। তিনি আরো বলেন, বছরের সবচেয়ে বেশি গত শনিবার সব্বোর্চ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।

চাঁদপুর টাইমস রিপোর্ট : আপডেট ২:০০ এএম, ০৩ মে ২০১৬, মঙ্গলবার
ডিএইচ

Share