‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’দেশের অন্যতম কৃষিভিত্তিক জেলা। মেঘনা, পদ্মা ,ডাকাতিয়া ও মেঘনা ধনাগোদা নদী বিধৌত চাঁদপুর জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। চাঁদপুর রেলস্টেশন ও নৌ-পথের কারণে চাঁদপুরকে একসময় বলা হতো প্রাচ্যের সিংহদ্বার। নৌ-বন্দর, রেলওয়ে জংশন , ইতিহাস , ঐতিহ্যে ,ব্যবসা-বাণিজ্যে,শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ চাঁদপুরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তিন-তিনবারই এসেছেন।
তিনি কলকাতা থেকে এসে চাঁদপুর হয়ে দেশের তিনি বিভিন্ন জেলা শহরে সফর করেন। সর্বপ্রথম ১৯২১ সালের ৮ জুলাই অল্প সময়ের জন্যে কুমিল্লা থেকে লাকসাম হয়ে চাঁদপুরে আসেন আমাদের প্রিয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বর্তমান চাঁদপুর প্রধান ডাকঘরের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ডাক-বাংলোয় তিনি তখন অবস্থান করেন বলে জানা যায় ।
পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার ১৯২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মিজোরাম থেকে কুলাউড়া দিয়ে রেলযোগে প্রিয় কবি নজরুল চাঁদপুর আসেন। তৃতীয়বার ১৯২৮ সালে কবি নজরুল গোয়ালন্দ থেকে স্টীমার যোগে চাঁদপুর আসেন এবং চাঁদপুর থেকে ট্রেনে সিলেটে চলে যান। চাঁদপুরে এ দু’বারে কতক্ষণ স্টীমার থেকে নেমে কোথায় আসেন বা খাবার খান এবং কখন আসেন বা কোথায় অবস্থান করেন এর সঠিক তথ্য জানা সম্ভব হয় নি।
চাঁদপুরে তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ২০০৮ সালে রোটা.কাজী শাহাদাত চাঁদপুরের‘সপ্তসুর সঙ্গীত একাডেমি’র এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে প্রথমবার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম চাঁদপুরে আগমনের বিষয়টি তাঁর বক্তৃতায় উপস্থাপন করেন। ফলে চাঁদপুরের সংস্কৃতিমনা ও সুধীমহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদপুরের প্রথম মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামানুসারে চাঁদপুর পৌর স্ট্যান্ড রোডটির নামকরণ করেন ‘কবি নজরুল সড়ক্।’ চাঁদপুর রোটারী ভবনের পশ্চিম-উত্তর পাশে কবি নজরুলের ছবিসহ বর্ণনায় একটি বিলবোডও স্থাপন করে রেখেছে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘জাতীয় নজরুল সম্মেলন ২০২০’ ৪-৬ মার্চ চাঁদপুর শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষামন্ত্রী ও চাঁদপুর-হাইমচর আসনের এমপি ডা.দীপু মনি এর উদ্বোধন করেন।
চাঁদপুর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের প্রবেশাদ্বরের দু’পাশে জাতীয় কবি’র শেষ ভাষণ, মা কবিতা ও প্রিয় কবি নজরুল সম্পর্কে একটি অনুচ্ছেদ ও অপর পাশে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পাশে নজরুলের ছবিসহ একটি বিলবোড যথাযথভাবে শিক্ষার্থীসহ যে কোনো দর্শণার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণে কিংবা স্মরণে সংরক্ষণ করে রেখেছেন কলেজ কর্তপক্ষ। যা খুবই দৃষ্টিনন্দন। ২০০৭সালে মতলব নজরুল একাডেমি কর্র্তৃক জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নজরুলের কবিতা-গল্প-উপন্যাস
বাংলা সাহিত্যে আমাদের শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বাংলা ভাষার অনেক কবি ও সাহিত্যিকের কবিতা ও গল্প আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এর মধ্যে সবচাইতে বড় অংশ দখল করে আছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের কবিতা ও গান। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অপরিসীম। বিশেষ করে তিনি আমাদের বিদ্রোহী কবি,মানবেতার কবি, প্রেমের কবি ও তিনি আমাদের জাতীয় কবি। পরাধীনতায় শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর কবিতাগুলো প্রেরণা যুগিয়েছে।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ৩টি স্তর বিদ্যমান। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর।
প্রাথমিক : ২০২০ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্য বই থেকে সংগৃহীত তথ্যে জানা যায়- আমার বাঙলা বই প্রাথমিকের তৃতীয় শ্রেণির আমাদের প্রিয় কবির রচিত রণসঙ্গীতে ৮ লাইন-চল্ চল্ চল্-স্থান পেয়েছে। ৪র্থ শ্রেণিতে ‘মা-কবিতাটি ৭৫ পৃষ্ঠায়, ৫ম শ্রেণিতে মা কবিতাটি স্থান পেয়েছে।
মাধ্যমিক স্তর : দেশের মাধ্যমিক স্তরে স্কুল ও মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ৯ম-১০ম শ্রেণি পর্যন্ত বেশ ক’টি কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ ‘মানুষ’ কবিতা ও ২০১৩ পৃষ্ঠায় ‘উমর ফারুক ’ কবিতা সন্বিবেশিত হয়েছে। এছাড়াও দাখিল গদ্যাংশের ৮৩ পৃষ্ঠায়‘ উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে।
নজরুল
উচ্চ মাধ্যমিক : একাদশ ও দ্বাদশ সাহিত্য পাঠে উচ্চ মাধ্যমিক ও আলিম ‘আমার পথ’ প্রবন্ধ ও ‘ জীবন বন্ধনা ’ও সাম্যবাদী কবিতাটি স্থান পেয়েছে। স্নাতকে বাংলায় রাজবন্ধীর জবানবন্দী ও চৈতি হওয়া প্রবন্ধ দু’টো সংকলিত হয়েছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনা বয়েছে সকল শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয়পত্রে।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল অমর হয়ে আছে তার কবিতার,নাটকে,প্রবন্ধ ও উপন্যাসে। বাঙালির প্রিয় কবি নজরুল। বাঙালির গর্ব নজরুল। তিনি সৃষ্টির দ্বারাই বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন ও থাকবেন। বাঙালি জাতি তাঁকে চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাঁর সাহিত্য যুগ যুগ ধরে অন্যায়, অবিচার,অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আমাদের প্রেরণা যোগাবে। নজরুল শুধু একটি সময়ের কবি নন। তিনি সব সময়ের মানুষের কবি।
তথ্যসূত্র : জাতীয় নজরুল সম্মেলন ২০২০ এর ম্যাগাজিনে প্রদত্ত শিক্ষামন্ত্রী ও চাঁদপুর-হাইমচর আসনের এমপি ডা.দীপু মনি’র বাণী, সদ্য সাবেক জেলা প্রশাসক মো.মাজেদুর রহমান খানের বাণী,চাঁদপুর রোটারী ভবনের বিলবোর্ড এবং চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদপ্তর প্রকাশিত মাসিক নবারুণপত্রিকা থেকে সংগৃহীত।
লেখক : আবদুল গনি,শিক্ষক , সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক,নজরুল গবেষণা পরিষদ, চাঁদপুর। ২৪ মে ২০২৩
Edit